শেষরাত্রি



    
    আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলাম।

    অপেক্ষা করছিলাম অনেক আশা নিয়ে। এই বর্গাকৃতির শূন্য ঘরে সামান্য সান্নিধ্য খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছি বহু আগে। ভোরবেলা ঘরের বাইরে পাখিদের কিচির মিচির শোনা যায়, সন্দেহ হয় সত্যিই তা শুনলাম কি না। হয়তো পাখিরা কিচির মিচির করে না, স্মৃতি আমাকে এতটাই ধোঁকা দেয় আজকাল যে অবাস্তব কোন শব্দ আমি কল্পনা করি। পাখি বলতে কিছু নাও থাকতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। মাঝে মাঝে বিশ্বাস হতে চায় না একটা প্রাণী আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, বাতাসে ডানা মেলে ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষের মত গৃহবন্দী প্রজাতির পদচারণ যে গ্রহে তাতে মুক্তির উচ্ছ্বাস অনুভব করার ধৃষ্টতা পক্ষীকুলের একটি জ্ঞান-বুদ্ধিহীন সদস্য আদৌ কি দেখাতে পারে?

    জ্ঞান-বুদ্ধির প্রসঙ্গ যেহেতু এলো, আজকাল আমার নিজের সম্বল নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। রূপকথার গল্প পড়েছিলাম ছেলেবেলায়। পক্ষীরাজ ঘোড়া, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, হিংসুটে সতীন আর দিঘির নিচে রাক্ষসের প্রাণ-ভোমরা সবই কিছু কিছু মনে করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কথা মনে আছে। এখন হঠাৎ কোন দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, সত্যিই কি এরা ছিলো নাকি আমার মনের কল্পনা। হয়তো মনে মনে এ কাহিনী, ও ভাষা আমিই সৃষ্টি করেছি। মনে হয় আমিই রবীন্দ্রনাথ।

    স্কুলে পিথাগোরাসের উপপাদ্য পড়তে হতো আমাদের। অঙ্ক স্যারের নাম ছিলো জালালউদ্দিন, তার বেতের ভয়ে উপপাদ্য জাতীয় সংগীতের মত মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। তার হাড়-চামড়ায় কী আছে কখনও বোঝার চেষ্টা করি নি। কলেজে ওঠে সায়েন্স ছেড়ে দেওয়ার পর প্রয়োজন একেবারেই ফুরোলো। তবু মস্তিষ্কের কোনো খেয়ালে পিথাগোরাসের ‘গান’টা আমার আজও মনে আছে। তাতেও সন্দেহ হয়, সত্যিই এরকম কিছু আছে তো নাকি সব আমার কল্পনা? কাগজে লিখে অঙ্কটা আমি আজকাল মেলানোর চেষ্টা করছি। এক বাক্য প্রমাণ করার জন্য দশ বাক্য প্রমাণ করতে হয়, স্কুলে মুখস্থ করে গণিত পাশ করা ছাত্রের পক্ষে কাজটি মোটেও সহজ নয়। তবু আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ যেদিন প্রমাণ হয়ে যাবে, সেদিন আমি নিশ্চিত হতে পারবো পিথাগোরাস ছিলেন, তার উপপাদ্য এখনও ছেলেমেয়েরা মুখস্থ করে চলেছে।

    আমার ঘরটি চিলেকোঠা। আলোবাতাস আসে না তেমন। তবু মাথার ওপর ফ্যানটা ঠিকমতই ঘুরে, এদিকে লোডশেডিং খুব একটা হয় না। গরমকালে যা একটু কষ্ট, শীত-বর্ষায় ঠাণ্ডা বাতাসে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ভালোই লাগে। কিছু কিছু দিন গরমটা আর সহ্য করা যায় না, তখন ছাদে গিয়ে দাড়াই। বাড়িটা ঢাকার তুলনায় ছোট, মাত্র দু’তলা। যথেষ্ট পুরনো হয়েছে, ঘরের রঙ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। পাড়াটাই অতীতের, বিশ-ত্রিশ বছর আগের আর্কিটেকচার এখনও পুরোপুরি মুছে যেতে পারেনি। তবু তার ফাঁকে ফাঁকে দশতলা-পনেরতলা বিল্ডিঙগুলো বুর্জোয়ার মত দাড়িয়ে গেল। আরও হবে, আমার মার চাচার করা এ বাড়িটাও রইবে না।

    ছাদের কথা বলছিলাম। একরকম স্টোররুমই হয়ে গেছে ছাদটা, দুনিয়ার জঞ্জাল, ভাঙা আসবাব, নষ্ট যন্ত্রপাতির ঠাই হয়েছে এখানে। এদের সাথে আমার বসবাসটাও বেশ সার্থক মনে হয়, আমিও ওই অকেজো মানুষ কি না। অথচ কি সুন্দর একটা জায়গা হতে পারতো এটা। কিছু ফুলের গাছ থাকতে পারতো, একটা ছাউনি, দু’টো বেতের চেয়ার। বিকেলের নরম রোদে চা খাওয়ার মোক্ষম স্থান। লাগোয়া টয়লেটও আছে একটা, যার কারণে আমার নিচে যাওয়ারও কোন প্রয়োজন পড়ে না আজকাল।

    সবকিছুই ঠিক ছিলো, কিন্তু তেমন সৌখিন মানুষটি হবে কে? মা’র চাচাতো ভাই মানে মামার সংসার খুব বড়, পুরো দু’তলায় তাদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সংসারে কর্মক্ষম লোক বলতে মামা নিজে, তার চাকরিটা খুব একটা প্রচার করার মত কিছু নয়। তার বড় মেয়ে পাড়ার একটা স্কুলে পড়াতো, কিছুদিন আগে মুক্তাআপুর বিয়ে হয়ে গেছে। নিচতলাটা একটা প্রেস ভাড়া নিয়েছে বাঁধাই করার জন্য, সে কল্যাণেই কিছুটা টাকা-পয়সা পরিবারে যুক্ত হয়।

    আমার খাবার নিয়ে আসে ঝর্ণা। আমি যতক্ষণ খাই ততক্ষণই পাশে বসে থাকে, কথা বলে “আহারে, বাপ-মা মরা পুলাটার লাগি কারও মনে মায়া দয়া নাই। হাজার হোক মামা, ক্যামনে একলা ঘরটাত ফালায়া রাখছে। কেউ একবারও দেখবার আসে না।“

    “তুমি আসলেই হবে।“

    আমার কথা শুনে ঝর্ণা লজ্জা পায়। কেন পায় অনুমান করতে পারি। মাঝে মাঝে মনে হয় একবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেই, কিন্তু প্রশ্নটা কখনও করা হয় না। ক্যান্সার প্রতিদিন একটু একটু করে আমাকে শুষে নিচ্ছে। শরীর ছিবড়ে হয়ে গেছে, চিন্তার নেই ঠিক। শুধুশুধু আরেকজন মানুষকে জড়িয়ে লাভ কী?

    না, সত্যি কথাটাই বলি। এতদূরের চিন্তা আমি করি না। ঝর্ণা আমার কথার মানে বুঝতে পারে না। আমি যখন বলি ‘তুমি আসলেই হবে’, তার অর্থ হচ্ছে যে কোন একজন হলেই হলো। শুধু খাবারটাই তো দিয়ে যাওয়া, একবার খোঁজ নেয়া বেঁচে আছি না মরে গেছি। সে কাজ ঝর্ণা করে নাকি গলির মোড়ের চায়ের দোকানের গোঁফঅলা দোকানী করে তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

    তবু যদি একজন মানুষ বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো আমার কাছে তাতেই বা কী? আমার শরীর-মনের সে সাহসটুকু করার ক্ষমতা অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। অথচ, বয়স আর কতই হবে? ঝর্ণার থেকে তিন বছর বেশি বড়জোর। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরুলাম সে মনে হয় তিন-চার বছর হলো। টিউশনি করে চলছিলাম, খারাপ চলছিলো না। কোন পিছুটান নেই, আমার ওপর নির্ভর করার মতও কোন মানুষ ছিলো না। মা মারা গেছে বহুদিন আগে। বাবা মরলো পড়াশুনার মাঝে, ঐ ক্যান্সারেই। তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে এক বছর নষ্ট হয়েছিল। তখন একটু দুঃখ (আর গোপনে বলি, সামান্য রাগ) হতো, এখন আমি তাদের ঊর্ধ্বে চলে গেছি। কেবল মনে হয়, বাবার ক্যান্সার আর কয়েকটাদিন অপেক্ষা করলেও পারতো। বাপ-ব্যাটার একসাথে ধরা পড়লে ভালোই হতো, দু’জন একসাথে পড়ে থাকতাম।

    আমার এ রোগ যখন ধরা পড়লো তখন আমি ছোটখাটো চাকরির চেষ্টা করছি। পেয়েও যেতাম সম্ভবত। মেসে থাকি, তিন-চারটে টিউশনি করাই, ব্যাচেলর মানুষের আর কী লাগে? আগের জীবনটাও একেবারে বিফল কাটেনি। দু’দুটো প্রেম করেছি, পলিটিকাল পার্টিতে কর্মী হিসেবে নামটাও যুক্ত হয়ে ছিলো। পৃথিবী এরকম অপদস্থ করবে আমাকে ভাবতেই পারিনি। একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম, পাশার দান উল্টে গেলো। টিউমার ছিলো একটা মাথায়, কোনভাবেই সারানোর উপায় নেই।

    প্রথম কিছুদিন সবকিছু ঠিকমত বুঝতে পারি নি, মনে হচ্ছিল ঘোরে আছি। ঘোরটা যখন কাটলো, তখন বিছানায় স্থায়ী শয্যা নিলাম। কোথাও যাই না, বের হই না, কারও সাথে কথা বলি না। ওদিকে মেসে আমার সাথে থাকাও অন্যদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। অসুস্থ মানুষ, খেয়াল রাখার কেউ নেই। হঠাৎ করে মারা গেলেও সমস্যা। ওরাই অনেক চেষ্টাচরিত্র করে আমার এই মামার নাম বের করলো, তারপর হাতে পায়ে ধরে মামাকে রাজি করালো। তারপর একদিন এ বাড়ির চিলেকোঠায় আমি জায়গা নিলাম।

    ঝর্ণা যা বলে বলুক, মামার ওপর আমার কোন রাগ নেই। টানাটানির মাঝে আমাকে যে থাকতে দিয়েছেন তাই আজকাল কে করে? শান্তিতে ঘুমচ্ছি, প্রতিদিন খেতে পারছি। ব্যাংকে আমার কিছু টাকা ছিলো, খরচের জন্য সেগুলোও মামীকে দিয়ে দিয়েছি। ঝর্ণা মামীর খালাতো কিংবা ফুফাতো বোন, সেও এ বাড়িতে থাকে, কাজটাজ করে দেয়। মামী তাকে দায়িত্ব দিয়েছে আমার খেয়াল রাখার জন্য। এ আদেশের কোন বরখেলাপ হয়নি আজ পর্যন্ত। যদিও ঝর্ণা মাঝে মাঝে এসে ঘ্যানঘ্যান করে ওষুধ কিনে খাওয়ার জন্য, আমি বিরক্ত হই না। বোকা মেয়ে এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না যে ফাঁসির আসামীরও বাঁচার সম্ভাবনা আমার চেয়ে বেশি। কষ্ট হবে, তবু এত টাকা দিয়ে কিছু অনর্থক কেমিক্যাল কেনার কোন মানে আমি খুঁজে পাই নি।

    চিলেকোঠার শুরুর দিনগুলো অসহ্য লাগতো। মাঝে মাঝে ভাবতাম, নিকুচি করি ক্যান্সারের। দু’তলা থেকে লাফ দেই নিচে, সবকিছু চুকেবুকে যাক। কিন্তু কাজটা করা হয়নি। হাজার হোক দু’তলা, কতটুকুই বা উঁচু হবে? যদি না মরি তাহলে হাত-পা ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। এখন তো তাও নড়তে-চড়তে পারি, শরীরের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আছে। তখন তাও থাকবে না। যদি পাঁচতলা হতো তাহলে সম্ভবত অপেক্ষা করতাম না। এই অসম্ভব বিরক্তিতে ভুগতে হতো না।

    বন্ধুবান্ধব নেই আমার। ছিলো, অনেকজনই ছিলো। তাদের সাথে সিগারেট খেয়েছি, শখ করে কয়েকবার মদও পড়েছে গলায়। যেদিন টিউশনি থাকতো না সেদিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতাম। একবার কয়েকজন মিলে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলাম। সময়টা খারাপ ছিলো, গিয়ে পড়লাম ঝড়ের মধ্যে। ভ্রমণ উঠলো লাটে, তবে মজা একেবারেই কিছু হয়নি তা বলবো না। আজ সবাই হারিয়ে গিয়েছে। না, ওদের দোষ দিচ্ছি না। আসলে আমার অবস্থার কথা কেউ জানে না। মোবাইল ফোনটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে মাসের পর মাস। যারা জানে তারা আমি কোথায় থাকি তা বলতে পারে না।

    কবিরের কথা মনে আছে স্পষ্ট। হ্যাংলা-পাতলা ছেলে, কথায় আঞ্চলিক টান এতটাই ছিলো যে ফার্স্ট ইয়ারে ও কী বলছে তাই আমরা সহজে বুঝতে পারতাম না। আস্তে আস্তে ওর ভাষাও পাল্টালো, আমাদের অনুধাবন ক্ষমতাও বাড়লো। কবিরের কানেকশন ছিলো ভালো। মামা-চাচা নয়, খালার জোরে বের হয়েই চাকরি হয়ে গেলে তার। তারপর বিয়ে করেছে, তার শ্বশুরবাড়ির ছাদে ঝুলতে থাকা কাপড় এ বিল্ডিং থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সেভাবেই কেমন করে জানতে পেরে কবির একদিন দেখা করতে এসেছিলো।

    টিংটিঙে ছিলো বলে আমরা ক্ষ্যাপাতাম ওকে একসময়। এখনও তার স্বাস্থ্যের কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, কিন্তু আমার ওজন কবিরের থেকেও কমে গেছে। তবে ভাষাটা পাল্টে গেছে কীভাবে যেন, মাঝে মাঝে দু-একটা শব্দ হোঁচট খেলেও কবিরের মুখ থেকে মালিশ দেয়া শহুরে বাংলাই বের হচ্ছিল।

    “এ কী অবস্থা হয়েছে?”

    “ক্যান্সার। নাদুস-নুদুস হওয়ার কোন সুযোগ তো নেই।“

    “চিকিৎসা করাচ্ছিস না?”

    “এ জিনিস সারবে না। শুধু শুধু টাকা খরচ করে লাভ আছে? তাছাড়া, টাকা আসবে কোথা থেকে? দেখছিস না, অন্যের বাড়িতে পড়ে আছি। খাই-দাই, ঘুমাই।“

    “সারাদিন এখানেই শুয়ে থাকিস?”

    “হ্যাঁ।“

    “কেমন করে? কী ভয়ানক গরম এখানে, আমি তো এখনই ঘামতে শুরু করেছি।“

    “আমার আর কাজ কী? ঘামলে ঘামি, সেটাও খারাপ লাগে না। অন্তত, কিছু তো হচ্ছে। এছাড়া আর কি ই বা করার আছে? মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে দাড়াই, এতটুকুই।“

    “সময় কাটে কেমন করে?”

    আমার হাসি পেয়েছিলো, “জেলখানায় ফাঁসির আসামীর যেভাবে কাটে। সময় চলে যায়, খেয়াল থাকে না। এই গরমটা আছে বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, অজ্ঞান হয়ে যাই। শরীর তো দুর্বল হয়েই আছে। এর বাইরে কিছু আসলে আজকাল টের পাই না। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটে।“

    কথাটা মিথ্যা নয়। আজকাল আমি দিনের বারো ঘণ্টাই ঘুমাই। রাতে ঘুম, দুপুরে ঘুম, সন্ধ্যায় ঘুম। শরীর সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে, সময় হলেই চোখ বুজে আসে। আমি চোখকে বাঁধা দিই না, তন্দ্রার জগতকে হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাই।

    কবির বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলো না, আমার উৎসাহহীন জবাব ওকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছে যে তা আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কী ই বা করার ছিলো আমার? জোর করেও আজ কোন উৎসাহ মনের মাঝে আমি জন্ম দিতে পারি না। কিছু করতে ইচ্ছে হয় না, কথা বলতে কষ্ট হয়। কবির জিজ্ঞেস করলো, “কী চিন্তা করিস?”

    “চিন্তার কোন শেষ আছে নাকি? এই যে দেখছিস ফ্যানটা, এটা নিয়ে চিন্তা করি। হাতগুলো যখন বনবন করে ঘুরে তখন ওগুলোকে আলাদা করে তো আর দেখা যায় না। তবু তাকিয়ে থাকি মাঝে মাঝে, যদি টের পাওয়া যায় ঠিক কোথায় একটা হাত এখন আছে। কালকে কৈ মাছ খেয়েছিলাম, সেটা নিয়েও চিন্তা করি। এর আগে কবে খেয়েছিলাম, সত্যিই খেয়েছিলাম কি না। এই যে তুই গলায় টাই পড়েছিস, তাতে যে গোল গোল ফুটকিগুলো সেগুলো নিয়েও চিন্তা করবো নিশ্চয়ই। এক-দুইমাস পর মনে করার চেষ্টা করবো ডিজাইনটা ঠিক কেমন ছিলো, কয়টা বৃত্ত ছিলো, ছোট না কি বড় এসব।“

    ঝর্ণা চা নিয়ে এসেছিলো, কবির কয়েকটা চুমুক দিয়েই পালালো। কী আশ্চর্য, ও চলে যাওয়ার পর একটু দুঃখই হচ্ছিলো। দুঃখটা আবার ভালোই লাগছিলো, অন্তত কিছু তো টের পাচ্ছি। মাঝে মাঝে রাতের দিকে ঝর্ণা এসে আমার দরজার পাশে দাড়িয়ে থাকে। আমি টের পাই, কিছু বলি না। ওইদিনও দাড়িয়ে ছিলো, পাশের বাড়ির জানালার আলো ওর লম্বা ছায়াটা আমার ঘরের মাঝে ফুটিয়ে তুললো প্রতিদিনের মত। দুঃখের অনুভূতিটা ফেরত পেয়ে মন ভালো ছিল কি না, তাই জিজ্ঞেস করলাম, “ঝর্ণা?”

    “জে।“

    “তুমি কিছু বলবে?”

    ও সাথে সাথেই উত্তর দিতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ্যের পর প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনে কিছু চান?”

    আমি কী কিছু চাই? একসময় হয়তো বাঁচতে চাইতাম, আমি একটু ভেবে দেখলাম এখন সে ইচ্ছাটিও নেই। আমি সম্ভবত কিছুই চাইনা। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে, কিন্তু সেদিন আলাদীনের দৈত্যকে হাতে পেলেও আমি কিছু চাইতে পারতাম না।

    জবাব দিলাম, “আজ আমি কিছু চাই না। হয়তো অন্যকোন দিন চাইতে পারি। দেখা যাক।“

    আরও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ঝর্ণা চলে গেল। সেদিন ভোররাতে স্বপ্ন দেখলাম আমার পানির গ্লাসটা ঘষতেই তা থেকে একটা জবড়জং দৈত্য বের হয়ে এলো। দৈত্য হাড়গিলে আর মিশমিশে কালো। তার চোখে লাল ফ্রেমের কাঁচের চশমা। স্বপ্ন তো আর সত্যি নয় যে চুলের রঙ ঠোঁটের কোণের তিল চোখে পড়বে, কিন্তু যতদূর মনে পরে দৈত্যটার চোখমুখ মোটিভেশনাল স্পিকারদের মত চকচক করছিলো। সে জিজ্ঞাস করলো, “বল, কী চাও?”

    “যা চাই তাই পাবো?”

    “তাই পাবে মানে? এটা কী মগের মুল্লুক নাকি? আজকাল এত দরাজ হলে চলে না, বুঝলে। আমাদের সিস্টেম আপগ্রেড হয়েছে অবশ্য, ভালোবাসা-টালোবাসা চাইলে আজকাল সেটাও ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু এখন ধর তুমি একেবারে বিশ্বশান্তি চেয়ে বসলে, সে কী আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব?”

    “তাহলে উপায়?”

    “উপায় হচ্ছে আমাদের সংবিধানটা একটু ভালো করে পড়ে নেয়া। তবে তুমি আধমরা মানুষ, ও ঝামেলায় যেতে হবে না। কিছু একটা চাও, সম্ভব হলে চুপেচাপে দিয়ে যাবো খন। আজকাল সংবিধান প্রণেতারাই সংবিধানকে এক পয়সা গুণে না, আর আমরা একটু হাত-বেহাত করলেই দোষ?”

    “ধন্যবাদ। তো, তিনটা ইচ্ছা করা যাবে তো?”

    “হ্যাঁ, অবশ্যই! ও তো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের কালচার। আদ্যিকাল থেকেই জ্বীন-দৈত্যেরা তিনখান ইচ্ছা পূরণ করে আসছে, এখন করছে, ভবিষ্যতেও করবে। আলাদীনের প্রদীপ থেকে উপেন্দ্রবাবুর ভূতের রাজা, মিনার কুপি থেকে তোমার পানির গ্লাস এসব পাল্টাবে। কিন্তু তিনের কোন পরিবর্তন হবে না।“

    স্বপ্নে কোন চিন্তা করতে হয় না, আমি সাথে সাথে চেয়ে বসলাম, “আমি চাই পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।“

    “ওরেব্বাস, প্রথমেই তো আপদে ফেলে দিলে বাবা। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, অনুরোধ ফেলতেও পারি না তোমার। ঠিক আছে, পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হলো।“

    “দ্বিতীয়ত আমি চাই পৃথিবীর সকল প্রাণী দুঃখী হোক।“

    “তাও হলো।“
   
    “আর সবশেষে চাই, আমার মৃত্যু হোক।“
   
    “একেবারে মৃত্যু, আরও কয়েকটা দিন ভেবে দেখলে হতো না? মানে ধর ধনুক নিয়ে রাজা শিকারে গেলো। ঐ ঝোপের ফাঁকে হঠাৎ কিছু একটা নড়তে দেখে হরিণ ভেবে যদি তখনই সড়াৎ করে তীর মেরে দেয় তাহলে তো সমস্যা। পরে দেখা যাবে ও ছিলো কোন এক তপস্বী, অভিশাপ দিয়ে একেবারে নাকাল করে ছাড়বে তখন। তীর একবার যদি হাতছাড়া হলো তাহলে তো ওটিকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।“
   
    “তাহলে কী করি?”
   
    “আমি বলি কী, কিছুদিন চিন্তাভাবনা করে দেখ। যদি দেখলে মরতে আর ইচ্ছে হচ্ছে না তাহলে তো সব চুকেবুকেই গেলো। আর নয়তো এ কবিতাটা আবৃত্তি করবে একবার, তাহলেই কেল্লা ফতে! নির্ঘাত মৃত্যু।“

    
ট্যাঁশ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে,

মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে;

মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়,

মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়।

   
    “আরে, এ ছড়া তো আমি পড়েছি! সুকুমার মিত্রের ছড়া।“
   
    “সুকুমার রায়।“
   
    “যেমন মিত্র তেমন রায়। সে কথা থাকুক, আপনি দৈত্য হয়ে নির্লজ্জের মত অন্য মানুষের ছড়া চুরি করলেন?”
   
    “আহা, চুরি বলছ কেন? আমি কি এ দাবি করেছি নাকি যে এটা আমার লেখা। তাছাড়া, এমনি এমনি তো কবিতাটা বাঁছিনি। তোমরা তো সবাই ট্যাঁশ গরু, এর চেয়ে মোক্ষম সাহিত্য হবে কী?”
   
    আমি এখন পর্যন্ত লাইন চারটে আবৃত্তি করি নি। সময় খুঁজছি। ভোররাতের স্বপ্ন সত্যি হয়েও যেতে পারে। .যদিও আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছি, তবু এখনও সবকিছু ছেড়ে দিতে পারবো না। কিছু রহস্য এখনও সমাধান করা হয় নি। পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প কী আমি পড়েছিলাম? পিথাগোরাসের উপপাদ্য কি সত্যি? আমিই কি রবীন্দ্রনাথ? এ প্রশ্ন তিনটা আমাকে এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। যেদিন এদের উত্তর জানা হয়ে যাবে, সেদিন আমার আর কিছু করার থাকবে না।
   
    একটা ছোট আশা আছে আমার যে মৃত্যুটা অন্তত সাদাকালো বিরক্তিকর হবে না। যার জন্য এতদিন ধরে আগ্রহভরে অপেক্ষা করছি সে আমাকে হয়তো নিরাশ করবে না। সে দিনটি হবে স্পষ্ট, অর্থবহ, অবিস্মরণীয়। কেমন হবে আমি মাঝে মাঝে কল্পনা করার চেষ্টা করি।
   
    যেমন ধরা যাক, ঘুম থেকে ওঠে দেখলাম কবির আমার চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা সবাই। সেখানে মেহেরুবাও থাকবে, কলেজে থাকতে যার সাথে খুব ভাব ছিলো আমার। সে এখন ডাক্তার, হাতে একটা রিপোর্ট নিয়ে চিৎকার করতে করতে বলবে, “সব ইরেসপন্সিবল এরা! কোথা থেকে টেস্ট করিয়েছিলে তুমি? যত্তোসব লিখে দিয়েছে। তোমার ক্যান্সার-ট্যান্সার কিছু হয়নি। সামান্য রোগ, একমাস হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করলেই সেরে যাবে। Nothing to worry about. আমি ব্যবস্থা করে দেবো, তুমি সরকারি হাসপাতালেই বেড পেয়ে যাবে। কোন টাকা-পয়সা লাগবে না।“
   
    এর চেয়ে বড় খবর আর কী হতে পারে। সবগুলো খুশিখুশি মুখের মাঝে বসে আমিও হাসতে হাসতে দৈত্যের দেয়া কবিতাটা আবৃত্তি করবো, আর সাথে সাথে মারা যাবো। ক্যান্সারে ভুগে নয়, মন্ত্রের জোরে।
   
    আবার মনে হয় আমার মৃত্যু হবে মধ্যরাতে। সেদিনও ঝর্ণা দরজার পাশে দাড়িয়ে থাকবে। আমি জিজ্ঞেস করবো, “ঝর্ণা, কিছু বলবে?”
   
    “আপনে কিছু চান?”
   
    আমি আবার চিন্তা করবো। আমার ভবিষ্যতেও সম্ভবত কিছু চাওয়ার থাকবে না। কিন্তু মৃত্যুর দিনটি তো প্রতিদিনকার মত সোজাসাপ্টা সরল হতে পারে না। যদি একটা মানুষের জীবনও এলোমেলো করে দিতে পারি তাই বা কম কী? আমি উল্টো প্রশ্ন করবো, “আমি কিছু চাই না। তুমি কি কিছু দিতে চাও।“
   
    ও ঘরে ঢুকে আমার বিছানার ওপর বসবে। তারপর কী হবে কে জানে। আমি কেবল বলতে পারি একসময় না একসময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি বলবো।

ট্যাঁশ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে,

মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে;


    ঝর্ণা টেরও পাবে না আমি কখন মারা গেছি। আমি অদৃশ্য হয়ে দেখতে পাবো আমার দেহটা শুয়ে আছে, আর মৃত্যু এসেছেন আমাকে সঙ্গে নিতে। তার গায়ে জমকালো এক আলখাল্লা, হাতে ধরা এক মোমবাতি। আমার কেন যেন মনে হয় মৃত্যুর চেহারাটা দেখতে হবে মহাত্মা গান্ধীর মত।

    মৃত্যু বলবেন, “তাড়াতাড়ি চলুন, হাতে অনেক কাজ বাকি। এ ব্লকের আরেকজনের ক্যান্সার হয়েছে, আর রাস্তার ওপাশে এক বুড়ির বয়স হলো সাতানব্বই। তারপর যেতে হবে হাসপাতালে, দেড়বছরের একটা বাচ্চা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। এখন আশেপাশে সাংবাদিক-ক্যামেরা থাকবে না, খুব ভালো সময়। চলুন চলুন, দেরী করে লাভ নেই।“

    “আর একটু দাঁড়ান।“

    বিছানায় ঝর্ণা আমার পাশে শুয়ে আছে। আমি বলবো, “আপনি তো মৃত্যু, সবকিছুই জানেন। বলুন তো, এ মেয়েটা কি জীবনে সুখী হতে পারবে?”

    “তা জেনে আপনি কী করবেন?”

    “কৌতূহল, বলুন না।“

    “কেমন করে সুখী হবে? ঘুম থেকে ওঠে যখন টের পাবে সারারাত একটা মৃতদেহের ওপর কাটিয়েছে তখন সারাজীবনে এ স্মৃতি ভুলতে পারবে আপনার ধারনা? যখনই চোখ বুজবে তখনই মৃতদেহের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠবে। এ মেয়ের কপালে দুঃখ আছে।“

    “আহারে, বেচারি।“

    “বেচারির কী দেখলেন? ঐ যে বাচ্চাটার কথা বললাম, তার মা তো পাশেই শুয়ে আছে। বেচারি কাকে বলে তাকে দেখলে বুঝবেন। চলুন, যাওয়ার আগে একবার আপনাকে সেখানেও ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো না হয়।“

    কল্পনা এখানেই থেমে যায়। যদি মৃত্যুর পর সে মৃত্যুতে কেউ কষ্ট পায় তবে কি তাকে সার্থক-মরণ বলা চলে? হয়তো। আমি তাই চলে যাওয়াটাকে সার্থক করার চেষ্টা করছি। প্রতিদিনের বিচ্ছিন্নতার মাঝে বেঁচে আছি এ কারণেই, কোন একজনকে দুঃখ দেয়ার জন্য।

    বাইরে কাক ডাকছে। এই কুৎসিত-কদাচার প্রাণীটিও কি আমার তৈরি। এই কর্কশ গলা কি আমারই দেয়া। আমিই কি সৃষ্টিকর্তা? সকল অন্ধকার কার মাঝে ভর করে কোথায় গিয়ে ঠায় পায়, কে জানে।

 Painting used In the cover is "Self-Seer II (Death and Man)" by Egon Schiele 

ধূসর





বাচ্চা দু’জন। বাঁচাতে হবে একজনকে।

    আস্ত ঝামেলায় পড়া গেলো, ভাবলো কুদরত। আসলে, বাসার মানুষদেরই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব রয়েছে। নয়তো দু’টো ছোট বাচ্চার সাথে কুদরতকে রেখে চলে যেতো না কেউ। মনে মনে সবাইকে অভিশাপ দিলো একবার করে সে। অভিশাপ দিলো বাড়ির মালিককে। ঘোড়ার ডিমের বাড়ি বানিয়েছে শালা, কেমিক্যালের গুদামের ওপরে। আগুন লেগে দুই মিনিটেই সর্বনাশ। এখনই বের হতে না পারলে ছাইভস্ম হওয়াই ভাগ্যে থাকবে।

    সরকারের কোন চিন্তা নেই, এ অভিযোগও আছে তার। হারামজাদাদের কাজ অফিসে বসে বসে ঘুষ খাওয়া আর পাবলিকের টাকায় নবাবী করা। কেউ খেয়াল রাখবে না এই বিল্ডিঙের নিচে এত এত কেমিক্যাল পড়ে আছে। আগুন তো আগেও লেগেছে এভাবে। সরকার, পুলিশ ও বাড়িওয়ালাদের অকার্যকারিতা যে একই সাথে পাশবিক এবং শাস্তিযোগ্য সে সিদ্ধান্তে এলো ও।

    কিন্তু বাঁচানো যায় কাকে?

    ট্রাক চাপা দিয়ে তার ডানহাতটা গুড়িয়ে পা খোঁড়া করে দিয়েছে যে ড্রাইভার তাকেও অভিশাপ দিলো কুদরত। জাহান্নামে যাক শুয়োরটা, মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আপনাআপনি। এক দলা থুতু ছুঁড়ে ফেললো চকচকে কাঁচের টেবিলের ওপর। বাড়ি থাকলো তো টেবিলের চিন্তা। একহাতে বাচ্চা কোলে করে এই গরম আর ধোঁয়ার মাঝে চারতলা থেকে নিচে নামা সহজ কাজ? শালা তুই তোর বউ-বাচ্চা নিয়ে জ্যান্ত পুড়ে মর।

    আগুন ভালো করে লাগেনি এখনও, আর এক মিনিট লাগবে। চিৎকার শুরু হয়ে গেছে তবু। দমকল ডাকা হলেও লাভ নেই। এ চিপাগলিতে গাড়ি ঢুকবে না। প্ল্যান কে করে এসবের, আগুন থামবে এক বিল্ডিঙে লেগে? আরও লাগবে, পাশেরগুলোও ছাই হবে। হোক। মানুষ কিছু মরুক। কুদরত একা ভুগবে কেন?

    কিন্তু বাচ্চা একটাকে বাঁচাতে হবে। বড়ভাবীর মেয়েটা মাশাল্লা, হয়েছে ফুটফুটে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, ডাগর ডাগর চোখ। মুখে সুন্দরী মায়ের আদল স্পষ্ট। একটু একটু কথাও বলতে পারে। ফোকলা দাঁতে কী সুন্দর হাঁসে মেয়েটি। এসব কথাই কুদরতের মনে এলো। এত সুন্দর মেয়েটা বড় হবে না, আগুনে পুড়ে মরে যাবে ভাবতেই কষ্ট হলো তার।

    মমতাজের ছেলেটার বয়স বড়ভাবীর মেয়ের সমান। এ বাচ্চাটা কুৎসিতই হয়েছে, ভাবে কুদরত। কুচকুচে কালো হয়ে পৃথিবীতে এসেছে ছেলে। মুখের মাপজোখ ঠিক নেই, নাকের ডগাটা ওপরের দিকে ওঠে থাকে। আর কপালটাও কিছুটা বড়। স্বভাবটা বলতে গেলে ভালো নয়। মনে আছে সব কুদরতের। কিছুদিন আগেই ওর কোলে ওঠে জামাকাপড় নষ্ট করেছে হতচ্ছাড়া।

    মেয়েটা মরলে বড় দুঃখ পাবে বড়ভাবী। কী যে আদর করেন বাচ্চাটাকে তিনি, চোখের মণি একেবারে। ওর জন্য গুড়াদুধ আনতেই মমতাজকে নিয়ে এ অসময়ে নিচে নেমেছেন তিনি। দুধ ছিলো বাক্সে, বানানোর সময় অসাবধানে সবটা মেঝেতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। নাহ, স্বীকার করবেই সে, ভালোবাসেন মেয়েকে বড় ভাবী। না বেসে উপায় কী? এত চেষ্টা চরিত্র করে, এলোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি পীর-ফকির ধরে এতদিন পর একটা সন্তান এসেছে ঘরে। গ্রামে দুর্নাম কম তো হয়নি ওদের, সবাই বলাবলি করতো অলক্ষণে মহিলা বলেই নাকি পেটে বাচ্চা বাঁচে না। এবার মুখ বন্ধ হয়েছে তো সবার।

    মমতাজ অবশ্য টেরও পাবে না একটা ছেলে মরলে, কুদরতের তাই ধারনা। এটা সম্ভবত সাত নম্বরই হবে, আটও হতে পারে। আগের পক্ষেরও আছে দুজন। বাড়িতে বাচ্চা গিজগিজ করছে, দুইজনের খবর রাখলে তিনজন হারিয়ে যায়। যেগুলো বড় হয়ে গেছে সেগুলোও কোন কাজে আসে না, অকর্মণ্যের বাদশা সব। একটা কমলে হয়তো খারাপ কিছু হবে না, কুদরত নিজেকে বললো। না, প্রথমে কান্নাকাটি করবে সবাই। তারপর ঠিক হয়ে যাবে, হয়তো এতে ভালোই হবে সবার জন্য দিনশেষে। খেয়াল রাখার ঝামেলা থাকবে না, সম্পত্তির ওয়ারিশানও কমবে। বাচ্চা অসুখেও তো মরে।

    বড়ভাইও মেয়ে মারা গেলে কষ্ট পাবে। কিন্তু মমতাজের স্বামীর বুকের মাঝে হৃদয় বলতে কিছু নেই। টাকা থাকলে কী হবে, শালা একটা কঞ্জুস, খবিশ। আড্ডায় বসে বিঁড়ি খাওয়া আর বাচ্চা পয়দা করা ছাড়া কিছু পারে না জানোয়ারটা। জমিজমার দেখভাল সব করে তো মোক্তার দেওয়ান। সম্পদ কম নেই ব্যাটার।

    টাকা চেয়েছিলো কিছু কুদরত, মুখের ওপর না করে দিয়েছে। বউয়ের আপন বড় ভাই, কিছু দিতে তো পারতো। মদ-গাঁজা খেয়ে তো আর উড়াতো না সে, ব্যবসাই করতো। ট্রাক চাপা পড়ে হাত একটা গেছে, ডান পা’টাও নষ্ট। নয়তো কামাতে পারতো না কুদরত? করতোই তো চাকরি। সবশালা বেঈমান, স্বার্থপর।

    বড়ভাই কিছু অবশ্যই দেবে, ভাবে কুদরত। হোক চাচাতো ভাই, কিন্তু ভাই তো। যোগাযোগ অনেকদিন নেই, তাই জোর দিয়ে চাওয়ার জন্য মমতাজকেও সাথে এনেছে সে। দশ বাচ্চার মা মমতাজ, হু হু। মানুষ ভুলানোর কৌশল জানা আছে তার। স্বামীর মত নিষ্ঠুর না, ভাইয়ের জন্য দরদ আছে দিলে।

    এই প্রথম বোনের জন্য খারাপ লাগলো কুদরতের। আহারে, বেচারি। কোলের বাচ্চাটা, আদর করে নাম রেখেছে সোনা। মারা গেলে মায়ের মন কষ্ট পাবে না একটুও?

    তাছাড়া, কুদরত তো আপন মামা। কল্পনা করলো ও, সোনাকে যদি বাঁচাতে পারে তবে আর একটু বড় হলেই নিজের কাছে নিয়ে যাবে সে। বড় করবে নিজের সন্তানের মত। হলোই না হয় কুৎসিত, দিলটাই বড় জিনিস। জ্ঞান-সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ।সোনাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে ও, কলেজ পাশ করলে বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াবে। মামাতো তো ভুলে যাবে না ছেলেটা। মনে রাখবে। বুড়ো বয়সে দেখভাল করবে।

    কিন্তু মেয়ে মারা গেলে বড়ভাইও ভেঙে পড়বে। এ অবস্থায় টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু মেয়ে বেঁচে গেলে অন্য কথা। বড়ভাই-ভাবী কী খুশিটাই হবে! কুদরতকে কিছু চাইতে হবে না। বড়ভাই এমনিতেই টাকা দিয়ে দেবে। ব্যবসাতেও সাহায্য করবে। আর এই মেয়েটাও একদিন বড় হবে, বিয়ে হবে তার। তখন বিয়েতে ডাকবে না ওকে? সবাইকে বলবে না বড়ভাই কুদরতের জন্যই তার মেয়ের জীবন রক্ষা হয়েছে?

    কুদরত বলবে, সবাই আল্লাহর কুদরত ভাইজান, এই কুদরত তো কেবল উছিলা।

    তবু, বাচ্চাদের মাঝে পার্থক্য করা যায় না, ভাবে সে। যদি সুযোগ থাকতো তবে দু’জনকেই নিশ্চয়ই বাঁচাতাম। সব দোষ শালা ট্রাকড্রাইভারের, হাতটা নষ্ট করে দিলো। আর মমতাজের স্বামী হারামজাদা টাকাটা দিলো না, দিলে এ হাঙ্গামায় পড়তাম আমি? কিছুতেই না।

    হাহাকার, আর্তনাদ বাড়ছে। এখন নামতেই হয়, নয়তো একজনের জায়গায় তিনজন মরবে। একবার মাথায় এলো ডেকে দেখবে কেউ সাহায্য করতে আসে কি না। না, আসবে না। সবার জান নিয়ে টানাটানি। সবাই নিশ্চয়ই নিচে চলে গেছে, যারা যায়নি তারা চোখ বন্ধ করে ছুটছে। কেউ সাহায্য করতে আসবে না।

    মমতাজের ছেলে সোনা চোখ বন্ধ করে ঘুমায়। কিছুক্ষণ পর ঘর যখন ধোঁয়ায় ভরে গেছে তখন ঘুম ভাঙে সোনার। জানালার কার্নিশে আগুন পৌঁছে গেছে, পোড়া কাপড় ছিঁড়ে পড়ে গেছে বিছানায়। চাদরে আগুন ধরলো। নিঃশ্বাস নেয়া যায় না, কালো ধূম্র চোখ জ্বালিয়ে দেয়। কান্না শুরু হয়। এক বছরের শিশুর চলন ক্ষমতা থাকে না। আগুন যখন ওর শরীরে লাগলো তখন দুনিয়ার সমস্ত ভয়, বেদনা, বিভীষিকা এক খণ্ডে মিশে গেলো কান্নার সাথে। বেশিক্ষণ নয়। জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার আগেই নিঃশ্বাস বন্ধ হলো তার। সোনার ছোট ছোট চুলগুলো পুড়ছে তখন, বেড়ালের ছবি বসানো ছোট প্যান্ট আর নীল জামাটাও পুড়ছে। দগ্ধ মাংসের ঘ্রাণ নেয়ার কেউ অবশিষ্ট নেই আশেপাশে। সিলিং এর ফ্যানটি খুলে পড়ে যায় একসময় অঙ্গার রাঙা লাশটির ওপর। আরও অনেকক্ষণ সময় গেলে ছাই হয়ে যাবে সব।

তবু আমরা বড়ো ভালো আছি


কিছুদিন আগে একটা ডেইরি ফার্ম থেকে কিছু শুকনো খড় আনতে গিয়েছিলাম আগুন জ্বালানোর জন্য, আসার সময় এক বোতল ঘি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কেদার বললো সস্তায় পাওয়া গেছে। এখন কিছু সেগুন কাঠের টুকরো জ্বালিয়ে কয়েক মিনিট পর পর তাতে ঘি ঢেলে দেখছি কী হয়।

আগুনে ঘি পড়লে তা ছ্যাঁত করে বদরাগী মানুষদের মত জ্বলে উঠে, এই ছ্যাঁত শব্দটা বেশ ভালোই লাগছে আমার। তবে ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে, চশমা পরা বলে বেঁচে গেছি। এ ঘর থেকে ধোঁয়া সহজে বের হতে পারে না। কোন জানালা নেই, ছাদ এর কাছে নকশা করা ভেন্টিলেটরগুলো আছে বলে রাত না দিন তা বুঝা যায়। লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ বিল কমানোর জন্য। সত্যি বলতে কি, আমাদের বাজেটে কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু অতিরিক্ত খরচ আমি পছন্দ করি না।

আগুনের হলদে আলোতেই যা দেখার তা দেখা যাচ্ছে। মেঝেতে রাখা বোতলগুলোতে এখনও কিছুটা লাল তরল টিকে আছে। তাদের পাশে একটি কাগজের ঠোঙা। হাতলভাঙা রিভলভিং চেয়ারটি কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে কেবল, মানুষ হলে নিশ্চয়ই সেটি এতদিনে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নেমে যেত। মাথা হেলান দেয়ার জায়গাটা ছত্রাক জন্মে নষ্ট হয়ে গেছে। খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে কেউ এখানে বসতে চাইবে না। এই ঘরটা যখন কিনেছিলাম রিভলভিং চেয়ারটা তখন থেকেই ছিলো, আমিও অকেজো জিনিসটা ফেলতে পারিনি। তার পাশে একটা কাঠের চেয়ারের  উপর কমলা রঙের একটা নাইলনের দড়ি পেঁচিয়ে রাখা। রিভলভিং চেয়ারটায় আমি মাঝে মাঝে বসি, আপাতত অর্গানাইজেশন ম্যানেজমেন্টের উপর একটা বই সেখানে রাখা আছে। দেড় সপ্তাহ ধরে পড়ে বইটা আমি প্রায় শেষ করে এনেছি।

একেবারে কোনায় কাঠের লাকড়ি বড় একটা স্তূপ। সেখান থেকে কিছু নিয়ে ছোট অগ্নিকুণ্ডটি তৈরি করেছি আমি। কিছুক্ষণ পর বড় অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হবে। এসময় কিছুটা কষ্ট হয় আমার, যখন বড় আগুনের পাশে দাঁড়াতে হয় তখনের কথা বলছি। এই বদ্ধঘরে আলো-বাতাস আসতে পারে না ঠিকমত, তার সাথে আগুনের তাপ মেশে। চশমা পরেও চোখকে তখন পুরোপুরি বাঁচানো যায় না, আর ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসা তো আছেই। অক্সিজেন মাস্কের ব্যবস্থা করবো কি না ভাবছি। এই প্রজেক্টের পেছনে কম টাকা তো ঢালা হচ্ছে না, এফিসিয়েন্সি বাড়ানোর জন্য একটু ইনভেস্ট করা যেতেই পারে। তাছাড়া, কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্যের দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। যদিও আমি আর কেদার ছাড়া আর কেউ কাজটির সাথে যুক্ত নয় তবু হিপোক্রেসির থেকেও প্রফেশনালিজম শক্তিশালী শব্দ।

প্রজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা প্রয়োজন মনে হচ্ছে। দাপ্তরিক নামটি যদিও প্রকল্প নরমেধ আমি ছোট করে বলি নূরু। আমাদের কাজ বড় অগ্নিকুণ্ডে মানুষ নিক্ষেপ করা। জ্যান্ত মানুষ, ঐ সতীদাহের মত ব্যাপারস্যাপার। যাকে তাকে অবশ্য নয়, আমরা আপাতত কাজ করছি কেবল সুখী মানুষদের নিয়ে। ফিল্ড ওয়ার্কগুলো করে কেদার। শহরের পথে চলতে চলতে যাদের সুখী মানুষ বলে মনে হয় তাদের ধরে আনা হয় এখানে। রাস্তা থেকে সরাসরি মানুষ তুলে আনা অবশ্য সম্ভব নয়, আমাদের ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হয় টার্গেট কোন নির্জন স্থানে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর কেমন করে মানুষটিকে কব্জা করা হবে, বাঁধা হবে, গাড়িতে ওঠানো হবে তার সবটুকু নির্ভর করে কেদারের উপর। কেদারের ফিডব্যাক চেয়েছিলাম কিছুদিন আগে, সে বললো কাজ করে নাকি তার ভালোই লাগছে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে সে কাজের আনন্দটাই গায়েব হয়ে যায়।

যা বলছিলাম তাতে ফিরে আসি। কব্জা করে টার্গেটকে নিয়ে আসা হয় এখানে। মানুষ হাতের কাছে আসার পরই আমরা বড় অগ্নিকুণ্ড তৈরি করার কাজটুকু শুরু করি, টাইমিং ঠিক না রাখলে অযথা জ্বালানী নষ্ট হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ আগুন তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত হবু-মৃতের সাথে আমি কিছু কথাবার্তা বলি কেবল সময় কাটানোর জন্য, অন্য কিছু নয়। অধিকাংশ সময় কোন গভীর আলোচনায় যাওয়াই সম্ভব হয় না, কেঁদেকেটেই বাঁচে না লোকজন। কিন্তু কিছু করার নেই, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ভিকটিমরা ছাড়া ঘরে আর মানুষ থাকে কেদার। কেদারের সাথে কথোপকথন আর একটা কেদারার সাথে কথোপকথনে তেমন কোন পার্থক্য আমি খুঁজে পাই না।

তবে একজনকে পেয়েছিলাম যার সাথে কথা বলে ভালো লেগেছিলো। ভুল করে একবার কেদার সুখী মানুষ এর জায়গায় একজন নিহিলিস্টকে ধরে নিয়ে এসেছিলো। কতই বা হবে মেয়েটির বয়স, সাতাশ-আটাশ? কোন জীবন দর্শনের ট্যাগ তো তার গায়ে লাগানো ছিলোনা, কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুর অসারতা বুঝার জন্য ওর চোখের দিকে একবার তাকানোই যথেষ্ট মনে হয়েছিলো আমার কাছে। পরিচয়ের কোন প্রয়োজন পড়ে নি।

নাহ, নিহিলিস্ট বলাটা ঠিক হচ্ছে না। তারা বিশ্বাস করে জীবনের কোন অর্থ নেই। আসলে, সে ভয়াবহ শূন্যতাকে প্রকাশ করার জন্য সত্যিই কোন শব্দ আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু ওই মেয়েটির দিকে যতবার তাকিয়েছি আমি ততবার মনে হলো জীবনের অর্থ আছে কি নেই সে নিয়ে চিন্তা করাও গণ্ডমূর্খের কাজ। অর্থের কোন অর্থ নেই, মানের কোন মানে নেই। ছায়াপথের চেয়েও বড় এক নির্লিপ্ততা এই বর্গাকৃতির বদ্ধ-ঘরটিতে জায়গা নিয়ে যেন আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য গ্রাস করলো।

মেয়েটির চোখ বাঁধা ছিলো, আমি দাড়িয়ে ছিলাম তার ঠিক সামনে। বাঁধন খুলে দেওয়ার পর সে আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো, আমি একটিবার তার চোখের মণি নড়তে দেখি নি। কতক্ষণ এ করেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম আমি জানিনা, একসময় মনোটোনাস স্বরে সে জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে ধরে এনেছ কেন? মুক্তিপণ চাইবে? নাকি রেপ করবে?”

“না, না, ছি ছি। রেপ করবো কেন? সোজাসুজিই বলি, আপনাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। সেটাকে ঠিক খুন বলতে চাই না, কারণ ঝলসে যাওয়ার পর আমাদের দায়িত্ব শেষ, আপনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তা আমরা দেখতে যাবো না। আমাদের কাজ শুধু হাত-পা বেঁধে আপনাকে আগুনে ছুঁড়ে মারা।“

“কেন?”

“আমাদের কোন বড় উদ্দেশ্য নেই। ইচ্ছে হয় তাই সুখী মানুষদের ধরে ধরে আগুনে ছুড়ে মারি। বেকার থাকার চেয়ে কিছু একটা তো করা ভালো, তাই না?“

মেয়েটি হতাশ হলো যেন, “যা ভেবেছিলাম, আমার কেন’র উত্তর তুমি দিতে পারবে না। তোমার কাছেও কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু আর সবার মত তুমিও আমার প্রশ্নটি বুঝতে পারো নি।“

“প্রশ্ন বুঝতে পারি নি?” আমি লজ্জা পেলাম, “একটু বুঝিয়ে বলুন তো।“

“বুঝিয়ে কেমন করে বলি? একটা গল্প বলি তবে। রাজা অমরশক্তির তিন মূর্খ পুত্রকে বিষ্ণুশর্মা গল্প বলে শিক্ষা দিতেন। আমি গল্পটা বলি, তুমি বুঝতে পারলে বুঝে নিও।“ এ কথা বলে মেয়েটি গল্প শুরু করলো। আমি আর কেদার হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে গেলাম।

একবার হরিণ, বুনো শুয়োর, বাঘ আর অজগর মিলে ঠিক করলো জঙ্গলে বিপ্লব ঘটানোর। বনের রাজা সিংহকে সিংহাসনচ্যুত করতে হবে। বুনো শুয়োর বললো, “প্রথমে আমি ধাক্কা মেরে সিংহকে দুহাত দূরে ছুড়ে ফেলে দেবো।“ অজগর বললো, “ঠিক তখনই আমি ব্যাটাকে এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরবো যে সব নড়ন-চরণ বন্ধ হয়ে যাবে।“ হরিণ বললো, “তারপর সিংহের পেটে শিং ঢোকালেই পাকস্থলীর বারোটা বেজে যাবে।“ বাঘ বললো, “বাকিটা আমি দেখছি, কোন চিন্তা নেই।“

উপরে বসে ছিলো বানর, ওদের কথা শুনে সে আর হাসি থামাতেই পারে না। তার দিকে চোখ পাকিয়ে অন্য জন্তুরা প্রশ্ন করলো, “হাসছিস যে? এখানে হাসির কী আছে?” বানর হাসতে হাসতে জবাব দিলো, “সুন্দরবনে সিংহ আসবে কোথা থেকে?” বানরের কথা শুনে হরিণ, বুনো শুয়োর, বাঘ আর অজগরের খেয়াল হলো তাই তো, সুন্দরবনে তো সিংহ নেই। তাহলে সিংহাসনচ্যুত করবে কাকে? তখন তারা আর কী করবে, চারজন হতাশ হয়ে গাছের নিচেই বসে রইলো।

এসময় কোথা থেকে একটা বড় সিংহ এসে চারজনকে গপ করে গিলো ফেললো।

আমার সহযোগী কেদারের মন ছিলো অনেকটা শিশুর মতন। বাচ্চারা নিষ্ঠুরতা বুঝতে পারে না বলে না জেনেই কখনো কখনো নিষ্ঠুর হয়ে উঠে। কেদারও ছিলো তেমন। নতুন রাস্তা দিয়ে চলার সময় সে ল্যাম্পপোস্টের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো, পাগল দেখলে ধাওয়া করে বেড়াত। বেড়াল কী করে কেবল তাই দেখার জন্য একবার সে ওটাকে ছাঁদ থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে পানি ভরা বালতিতে ডুবিয়ে রেখেছিলো। জানোয়ারটি পানিতে যখন ছটফট করতে শুরু করলো তখন কেদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি নৃশংস আনন্দ বা পাশবিক উল্লাসের মত কিচ্ছু দেখতে পাই নি। ওখানে কেবল ছিলো নিষ্পাপ কৌতূহল। বাচ্চাদের মতই কেদারও গল্প শুনতে ভালোবাসে। সুতরাং এই গল্পটি শুনে ওর কাঁদো কাঁদো হয়ে যাওয়া মুখ দেখে আমি একটুও অবাক হইনি, “এটা কোন গল্প হলো?”

আমি মেয়েটিকে বললাম, “সত্যিই তো। এ গল্পের কোন আগা-মাথা নেই। আপনাকে বলেছিলাম বুঝিয়ে বলতে, এ গল্প শোনার পর যেটুকু বুঝেছিলাম সেটাও এলোমেলো হয়ে গেছে। যে বনে সিংহ নেই সেই বনের জন্তুরা সিংহকে মারতে চাইবে কেন? আর সবার শেষে একটা সিংহ আবার কোথা থেকে চলে এলো? আর চারটে এত বড় বড় জন্তুকে এভাবে গিলে ফেলাও সম্ভব নয়।”

“তুমি এ কথাগুলো বলছ তারমানে তুমি এবারও বুঝতে পারো নি।“

“যার মানে নেই তা আমরা কেমন করে বুঝবো?”

“আমি তো মানে বুঝতে বলিনি, আমি কেবল বুঝতে বলেছি।“

আমরা মেয়েটিকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছিলাম নাইলনের দড়ি দিয়ে। এমনভাবেই বাঁধা হয়েছে যেন চামড়ায় দড়ি গেঁথে যায়। যতই চেষ্টা করুক সে নড়তে পারতো না। তার চিৎকারও সহজে বাইরে যাবে না, ঘরটি সেভাবেই বানানো। কেউ বাঁচাতে আসবে না। অগ্নিকুণ্ড তখন প্রায় তৈরি হয়ে গেছে, আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। আমরা দুজন এভাবেই বেঁধে মেয়েটিকে আগুনে ছুড়ে মারতাম। তার চিৎকার যদিও আমাদের সহ্য হবে না তবু আমরা আগুনের সামনেই দাড়িয়ে থাকতাম।

কিন্তু এই মানুষটির সামনে বসে আমার মনে হলো পৃথিবীতে আজ আমার থেকে অসহায় কেউ নেই। আমি যা অনুভব করেছিলাম তখন তা ঠিক ভয় নয়, একধরনের ক্ষুদ্রতা। আমার মনে হতে লাগলো দুনিয়ার সবকিছুতেই কোথাও একটু ভুল হয়েছে, একটা অণু-পরমাণুও সে ভুল থেকে বাঁচতে পারে নি। হঠাৎ করে কী হলো জানি না, আমি বললাম, “আপনাকে পোড়াবো না, আপনি চলে যান।“

“কেন পোড়াবে না বল তো?”

আমার মুখ থেকে বের হলো, “আমরা যে ধরনের মানুষকে পোড়াই আপনি সে ধরনের মানুষ নন। আমরা সুখী মানুষদের নিয়ে কাজ করি, আপনি সুখী মানুষ নন। কেদার একটা ভুল করে ফেলেছে। আপনি চলে যান।“

আমার মন বলছিলো, “আমি বাস্তবতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে গেছি। আমি আপনার শূন্যতার মাঝে আটকে গেছি। শূন্যতার কাছে ধ্বংস বলতে কিছু নেই।“

ওইদিন এরপর কী হলো তা আমার ভালো করে মনে নেই। কেদার বাঁধন খুলতে খুলতে একটা প্রশ্ন করেছিলো, সেটা আবছা আবছা মনে করতে পারি, “স্যার, ছেড়ে দিচ্ছেন। যদি পুলিশকে বলে দেয়?” আমার যতটুকু মনে পড়ে বলেছিলাম, “পুলিশ জানবে না। খুলে দে।“ তারপর মেয়েটি কী করলো কোথায় গেলো আমি বলতে পারি না। এর পরের সপ্তাহ আমরা সতর্ক ছিলাম, কিন্তু পুলিশ সত্যিই জানেনি। এ মানুষটির কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কিন্তু আমার ধারনা একটা সময় আসবে যখন আমরা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো না এ ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিলো নাকি আমি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।

পরে যখন কেদারকে জিজ্ঞেস করলাম সুখী মানুষ ধরে না এনে এই মেয়েটিকে কেন সে ধরে আনলো তখন সে জবাব দিলো প্রথমবার একে দেখে তার সুখী মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল। শহরে আমাদের একটি বড় বাড়ি আছে। বাড়িটি এতটাই বড় যে অসংখ্য মানুষের এই শহরে সেটাকে অনেকের জায়গার অপচয় বলে মনে হতে পারে। কেদার সে বাড়িতেই একটি ছোট ঘরে থাকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে সেদিন কেদার ঠিক সামনেই মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো। ক্লান্ত, ভাবলেশহীন মুখটিতে কোন সন্তুষ্টি, কোন সুখ কেদার দেখেছিলো সে প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও চিন্তা করে বের করতে পারিনি।

ঘরের লোহার দরজায় টোকা পড়লো। চারবার টোকা দিয়ে কিছুক্ষণ বিরতি, তারপর তিনটি টোকা, তারপর আবার চারটে। এই টোকার অর্থ কেদার এসেছে এবং তার সাথে কেউ আছে। কেবল চারটে টোকার মানে সে একা। আশেপাশে হঠাৎ করে কারও কেদারকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা নেই, যদি দেখেও ফেলে তবু তেমন সমস্যা হবে না। আমরা অনেকদিন ধরে এ এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি, লোকজন পরিচিত হয়ে গেছে। তারা আমাদের ঘাটায় না। কিন্তু কখন নতুন মানুষজন চলে আসে কে জানে। মুখবন্ধ করার জন্য কিছু একটা করতেই হবে তখন, আর তাতে ফোকাস চলে যাবে অন্য দিকে। আমি সেটা একেবারেই চাই না। তাড়াতাড়ি গিয়ে আমি দরজা খুলে দু’জনকে ভেতরে নিয়ে এলাম।

কেদার ধরে এনেছে একজন ছোটখাটো মধ্যবয়স্ক মানুষকে। গায়ে পাঞ্জাবি, মেহেদি করা চুল-দাঁড়ি। আগেই বলেছি, টার্গেটদের কেমন করে কব্জা করা হয় তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম আমাদের নেই। কেদার যা ভালো বুঝে তাই করে। কখনও কখনও সারা শরীর বেঁধে মুখে টেপ লাগিয়ে রাখা হয়, তখন আমরা দুজন ধরাধরি করে গাড়ি থেকে মানুষটাকে নিয়ে আসি। মাঝে মাঝে কেমিক্যাল দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলা হয় ভিকটিমদের। জ্ঞান ফেরাতে অনেক সময় লাগে, তাই সেসব দিনগুলোতে জ্ঞানহীন দেহগুলোকেই আগুনে ছুড়ে মারতে হয়। সে দিনগুলি আমার খুব খারাপ যায়, কথা বলার কোন সুযোগ থাকে না। যখন চামড়া পুড়তে থাকে তখন অবশ্য সবারই চেতনা ফিরে আসে, কিন্তু এ মুহূর্তে তো আর তাদের সাথে আলোচনা করা যাবে না।

কেদারের হাতে বড়সড় একটা ছুড়ি চকচক করছে। তার ভয়ে মানুষটি নিজে নিজেই ঘরে ঢুকলো। লোকটি একবার পেছনে তাকালো, মনে হয় ছুড়িটা এখনও কেদারের হাতে আছে কি না দেখার জন্য। “কোন সমস্যা হয় নি তো?“ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না স্যার। আঙ্কেল ভালো লোক, কথা শুনেন। আমি শুধু বলেছি আমি না বলা পর্যন্ত মুখ থেকে একটা কথা বের হলে এই জিনিসটা দুই পায়ের মাঝখানে বসিয়ে দেবো। এতেই কাজ হয়েছে, এখন পর্যন্ত একটা শব্দও আঙ্কেল করেননি। গাড়িতে জগজিৎ সিং এর গান বাজাচ্ছিলাম, সে গান শুনলে যে কেউ একবার আহা-উহু করবেই। আঙ্কেল কিছুই করেননি। ভালো লোক, খুবই ভালো লোক স্যার।“

“অস্ত্রটা কত দিয়ে কিনলে? ভালো স্টিল মনে হচ্ছে।“

আমার কথায় কেদার একটু লজ্জা পেলো, “আসলে কিনিনাই স্যার। খালাম্মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছি।“

“মা কিছু জিজ্ঞেস করেছে?”

“নাহ। চাইতেই দিয়ে দিলো।“

আমরা আঙ্কেলকে চেয়ারে বসিয়ে ভালো করে বাঁধলাম। ঘরের মাঝখানে ছোট আগুনটার দিকে তিনি ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছেন, কিন্তু পুরো কাণ্ডকারখানাটা সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি। পারলে এত শান্তিপূর্ণ ভাবে কিছুতেই লোকটাকে এখানে আনা যেতো না, কেদার শরীরের যেখানেই চাকু ঢুকানোর হুমকি দিক না কেন।

“আপনি এবার কথা বলতে পারেন।“ আমি আঙ্কেলকে কথা বলার অনুমতি দিলাম। উনি তবু মুখ খুললেন না।

“আরে এখন আর আপনাকে নিয়ে আমাদের কোন ভয় নেই। আপনি চিৎকার করলেও ঠিকমত বাইরে শব্দ যাবে না। আপনি কথা বলুন, চাইলে গানও গাইতে পারেন।“ আমি সাহস দেয়ার চেষ্টা করলাম। আঙ্কেল তখন কেদারের হাতের চকচকে ছুড়িটার দিকে তাকালেন। বেচারার মুখের অর্ধেক ঘাম নিশ্চয়ই গরমের কারণে তৈরি হয় নি। কেদার তখনই ছুড়িটা ছুড়ে ফেলি দিলো। কিছুটা নিরুদ্বিগ্ন হয়ে তিনি তখন মিনমিন করে বললেন, “দেখুন, আমাকে ধরে এনে আপনাদের তেমন লাভ হবে না। আমি সামান্য সরকারী চাকরি করি, বাসায় আমার ওয়াইফ, মা আর চারটে বাচ্চা আছে। আমি গরীব মানুষ, মুক্তিপণ হিসেবে বেশি টাকা দিতে পারবো না।“

“সামান্য কী আবার?” কেদার বললো, “আজকাল তো সবাই সরকারী চাকরিই চাচ্ছে। বেতন-স্কেল আমরা জানি না নাকি? দপ্তর ভালো হলে উপরি আয় তো থাকেই। ভালো বিয়ে করা যায়। টাকা নিয়ে এত চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। দরকার পড়লে আপনার ওয়াইফ বাপের বাড়ি থেকে টাকা যোগাড় করবে।“

আঙ্কেল ঢোক গিললেন, “ইয়ে ওদিকেও অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না কি না।“

“আহা, ব্যাপার তা নয়।“ আমি আস্থা দিলাম, “টাকা-পয়সার কথা হচ্ছে না, টেনশন করবেন না একদম। আপনার সাথে আমাদের কাজটা এই কয়েক ঘণ্টার বেশি নয়।“

আমার মনে হলো আঙ্কেলের মুখের ঘাম অর্ধেক কমে এসেছে, “তারমানে মুক্তিপণের বালাই নেই? তাহলে বাবারা, আমাকে এখানে ধরে এনেছেন কেন? আচ্ছা, আপনারা কি ছদরুল ফকিরের লোক? নিশ্চয়ই তাই। আমি তো উনাকে বলে দিয়েছি টেন্ডারটা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমার অফিসের বড় সাহেবেরও ক্যান্ডিডেট আছে, বুঝলেন তো? বসের উপর গিয়ে ছদরুল সাহেবকে সাহায্য করা কি আমার পক্ষে সম্ভব, বলুন? আচ্ছা, বেশ। বেশ। যদি কাজটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে আমি নাহয় বড় সাহেবকেই অনুরোধ করব। ভালো মানুষ বড় সাহেব, এই তো গত মাসেই আমার বাসায় দাওয়াত খেয়ে গেলেন। বড় সাহেব আমার কথা শুনবেন, দরকার পড়লে আমি পায়ে পড়বো। আপনারা ছদরুল সাহেবকে বলুন চিন্তা না করতে, টেন্ডারটা উনাকে পাইয়ে দেয়ার জন্য আমি জান দিয়ে দেবো।“

“বাহ, আপনার মত ডেডিকেটেড লোক থাকতে ছদরুল ফকিরের আর চিন্তা কী? কেদার, সময় হয়ে এসেছে। আগুনটা জ্বালাও এবার। এই বোতলগুলোর কোন একটায় কেরোসিন আছে দেখ। যেটায় আছে সেটা দূরে সরিয়ে রাখ। অন্ধকারে আরেকটু হলেই কেরোসিন গিলে ফেলেছিলাম। দুটোরই বিদঘুটে গন্ধ।“

কেদার কাজে লেগে গেল। প্রথম প্রথম আমরা ভেবেছিলাম কিছু কাঠের টুকরো একসাথে জড়ো করে তাতে আগুন ধরালেই কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু শুরুরদিকের কাজগুলোতে দেখা গেল নানারকম ঝামেলা। যতই বেঁধে রাখা হোক না কেন, আগুনের তাপে মানুষ ছটফট করবেই, গড়াগড়ি দিয়ে কয়েকজন আগুনের বাইরেও চলে এসেছিলো। কোনমতে ফ্যাসাদগুলো সামলানো হয়েছে। এরপর আমরা অন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। ঘরের মেঝেতে একটা গভীর গর্ত করা হয়েছে, চুল্লি বানানোর সময় কাঠ এমনভাবে সাজানো হয় যেন গর্তের উপরের জায়গাটা খালি থাকে। যখন আমরা একজনকে ছুড়ে মারি তখন তিনি জ্বলন্ত কাঠ ভেঙে নিয়ে গর্তে পরে যান, আর বের হওয়ার উপায় থাকে না। এতসব আয়োজন দেখেও আঙ্কেল চুপ করে রইলেন। সেটা ভয়ে হতে পারে, নির্ভয়েও হতে পারে। বেশি জানলে বেশি আপদ - এ নীতির তিনি সম্ভবত মজবুত বিশ্বাসী।

“তাহলে ভালো ব্যবস্থাই আপনার করা আছে দেখা যাচ্ছে। ছদরুল ফকির আপনাকে দিয়ে টেন্ডার পাইয়ে নেবে আর কিছু দেবে না এমন তো হতে পারে না।“

“আপনারা তো বাবা, সবই জানেন। কিন্তু ব্যবস্থা করা আছে সেরকম কিছু নয়। আসলে, এধরনের কাজ আমি পারতপক্ষে করি না।“ কী বলা ঠিক হবে আর কী বলা ঠিক হবে না এ চিন্তা করে তিনি এ জায়গায় চুপ করে গেলেন। আমি বললাম, “আরে বলুন, বলুন। আপনার একটা কথাও ছদরুল ফকিরের কানে পৌঁছুবে না। আমরাও কিছু ধরবো না, নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে আপনি কথা বলুন।“

“আপনি বড় ভালো লোক। বিশ্বাস করেই বলছি, এধরনের কাজ আমি পারতপক্ষে করি না। ধরুন এই এবারের মত কিছু কেস থাকে, যেগুলো না করলে জান-প্রাণ নিয়ে টানাটানি। আমাকে আপনি করাপ্টেড বলতে পারবে না। আমি একজন আদর্শ নাগরিক, সিস্টেমের মাঝে থাকতে হলে যেটুকু না করলেই নয় তার বাইরে আমি কখনও কিছু করি না।“

“তাহলে তো আপনার জীবনে অনেক কষ্ট।“

“না, না। ছোটখাটো সমস্যা তো থাকবেই। তবু আমরা বড়ো ভালো আছি।“

এসময় দরজায় টোকা পড়লো। প্রথমে তিনটে, তারপর দু’টো, তারপর তিনটে। বাইরে কে, কী কারণে এসেছে তা আমরা দু’জনেই বুঝতে পেরেছি। তবু বাড়তি সতর্কতা বলে একটা কথা আছে। কেদার গিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রাখলো, তারপর খুলে দিলো।

বাজারের দোকানের বাচ্চা ছেলেটা চা আর কোক নিয়ে এসেছে, প্রতিদিন এই সময়েই আসে। শুক্র আর শনিবার বাদে, এ দু’দিন আমরা থাকি না। এক সেকেন্ডের জন্য চেয়ারে বাঁধা মানুষটির দিকে তার চোখদুটো গিয়েই ফিরে এলো, আগুন আর ধোঁয়াকে গ্রাহ্যই করলো না। সারাদিন আগুন দেখেই দিন কাটে ওর। আমার মনে পরে, প্রথমবার যখন ছেলেটি ঘরে ঢুকে দেখেছিলো একজন মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তখন আতঙ্কে পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিলো, হাত-পা-চোখ-মাথা কিছুই আর নড়েনা। ছেলেটা কালো, কিন্তু ওইদিন অন্ধকার ঘরে কেবল আগুনের আলোয় ওকে দেখে মনে হলো ইউরোপিয়ানদের মত ফর্সা হয়ে গেছে। ওর ভয় একেবারে দূর হতে আরও কিছুদিন লেগেছে, কিন্তু এখন ছেলেটা কোন কিছুর তোয়াক্কা  করে না। কে বাঁধা আছে, কে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে এতে তার কিছু যায় আসে না। সত্যি সত্যি কাওকে আগুনে পুড়তে দেখেনি ছেলেটা, তবে আমার ধারনা সে দৃশ্যেও একসময় তার অভ্যাস হয়ে যাবে। বাচ্চারা এমনই। যারা আবর্জনায় জন্ম নেয় তারা নিজেকে আবর্জনাই ভাবতে শুরু করে।

আঙ্কেলের চিৎকার ছেলেটা কানেই তুললো না। প্রতিদিন যেখানে রাখে ঠিক সেখানে চায়ের কাপগুলো আর কোকের বোতলটি রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, “সেলাম ভাইজান।“ আমি মানিব্যাগ থেকে একটা বিশটাকার নোট বের করে ওর হাতে দিয়ে দিলাম। প্রতিদিন এত টাকা বখশিশ দিই না, আজ ভাংতি নেই বলে দিচ্ছি। বড়মাপের ঘুষ পেয়ে ছেলেটি ওর সবগুলো দাঁত আমাকে একবার দেখালো, তারপর কেদারকে এমনকি আঙ্কেলকেও একটা করে সালাম দিয়ে যে দিক দিয়ে এসেছে সেদিক দিয়ে বের হয়ে গেলো।

“চায়ের দোকানে কাজ করে। খুবই ভালো ছেলে।“ আমি বললাম। আঙ্কেল আমার কথায় সায় দিলেন, “হ্যাঁ, সালাম দিলো তো। আদব-কায়দা আছে। লেহাজ ছাড়া এ দুনিয়ায় মানুষের কোন দাম নেই।“

কাঠ সাজানো কেদারের হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা বোতলগুলোর এক একটা নিয়ে সে শুঁকে শুঁকে দেখছিলো। কেরোসিনের ছিপিটা খুলতেই গন্ধটা আমার নাকেও আলতো ধাক্কা মেরে গেল। যতটুকু বোতলে আছে তা দিয়ে এত বড় আগুন জ্বালানো যাবে কি না কে জানে। কেদার কাঠের উপর পুরোটাই ঢেলে দিয়ে কিছু শুকনো খড় জ্বালিয়ে উপরে ছুড়ে মারলো। আমি কথা বন্ধ করে আগুনের দিকে তাকালাম। আগুন পৃথিবীর ভয়ানকতম ছোঁয়াচে রোগ, ছড়িয়ে যেতে মিনিটও লাগে না।

পোড়া-কাঠের গন্ধ যখন সারা ঘরে ছড়িয়ে গেলো তখন আমরা শব্দ করা বন্ধ করে দিয়েছি। কেদার মুগ্ধ চোখে তার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি প্রাণ ভরে কাঠ-পোড়ার ঘ্রাণটুকু উপভোগ করছিলাম। চেয়ারে বসা মানুষটিও কোন কথা বললেন না। পরিবেশের অস্বাভাবিকতা তাকে বাকহারা করে দিয়েছে। তবু কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়, শেষপর্যন্ত আর থাকতে না পেরে আঙ্কেল বলেই ফেললেন, “আগুনটা কি খুবই জরুরী? মানে, আগুন তো আপনারা অবশ্যই জ্বালাবেন। যখন ইচ্ছে জ্বালাবেন। তবে বলছিলাম কি, এটা গরমকাল কি না। আমিও ঘামছি, আপনারাও ঘামছেন। একেবারে নিভিয়ে না দিয়ে অন্তত আঁচটা যদি কিছুটা কমান তাহলে বড় ভালো হয়।“

“বলছেন কি! আগুন নিভিয়ে ফেললে কেমন করে হবে? আগুনটাই তো সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট, ও ছাড়া তো সব আয়োজনই বৃথা। মানে ধরুন আপনার মেয়ের বিয়ে, বিয়েতে বরযাত্রী এলো, খেলো-দেলো, ঘরদুয়ার নোংরাও করলো। তারপর বিয়েটাই হলো না। সে কি ভালো হবে, বলুন?”

“তা তো বটেই, তা তো বটেই।“ আঙ্কেল আমাদের সাথে বেশি তর্কে যেতে চাচ্ছেন না যে তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, “কিন্তু আগুন দিয়ে কী হবে সেটা কী জানতে পারি?“

অনেকক্ষণ ধরেই কেদার কিছু একটা বলার সুযোগ খুঁজছে, এবার সে আর লোভ সামলাতে পারলো না, “ওই আগুনটা আরেকটু ভালো করে জ্বললে আপনাকে ওখানে পোড়ানো হবে।“

আকস্মিকতার একটা মাত্রা থাকে। সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মানুষ অবাক না হয়ে অন্য কিছু করে বসে। কেদারের কথা শুনে আঙ্কেল বাস্তবিকই হা করে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। “আমাকে পোড়ানো হবে?” হঠাৎ দমকে দমকে হাসতে শুরু করে এক লাফে তিনি অট্টহাসিতে পৌঁছে গিয়ে ঘরটাই কাঁপিয়ে দিলেন, “আমাকে পুড়িয়ে কি খাবেন নাকি বাবারা? আগেই বলে রাখি, আমি বুড়ো মানুষ, ডায়াবেটিসের রোগী। আমাকে খেতে একেবারেই ভালো লাগবে না। তবে ভালো করে লবণ আর মশলা যদি মাখিয়ে নেন তবে অন্য কথা। লবণ-মশলা কি আছে?“

“না, না, সে প্রশ্নই আসে না।“ আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, “আমরা যথেষ্ট সিভিলাইজড মানুষ, একেবারেই নরখাদক নই। ক্যানিব্যালিজমের মত বর্বর কাজ আমি কিছুতেই সাপোর্ট করি না। আগুনে নিক্ষেপ করার বিষয়টা সম্পূর্ণ আগুনের জন্যই, আপনি জ্বলেপুড়ে মারা যাওয়ার পর আপনার দেহের কোন ক্ষতি করা হবে না। তাছাড়া আপনি মুসলমান মানুষ, শবদাহ তো আর করা যাবে না। যা অবশিষ্ট থাকবে তা আমরা কবর দেয়ার ব্যবস্থা করব, লোক আছে আমাদের। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না আপনি, ধরে নিন আপনার ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছিল তাতে পুড়ে আপনি মারা গেছেন। এ ঘটনা তো ঘটছেই দেশে, কেউ তো কোন আপত্তি করছে না।”

মানুষটির চোখ তখন গোল ও লাল হয়ে গেছে, তার কতটুকু ধোঁয়ায় কতটুকু অবিশ্বাস আর আতঙ্কে কে জানে, “কিন্তু আমি তো বললাম ছদরুল ফকিরের কাজটা আমি ম্যানেজ করে দেবো। আল্লাহর কসম, আমার সন্তানের কসম দিয়ে বলছি বাবারা, আমার কথার বিন্দুমাত্র খেলাপ হবে না।“

“আমরা ছদরুল ফকিরের লোক আপনাকে কে বলল? সেটা আপনি অনুমান করেছেন মাত্র। আমাদের কাজটা একটা বেসরকারি প্রজেক্ট। আমরা সুখী মানুষদের ধরে আনি, তাদের আগুনে ছুঁড়ে মারি। আপনি সুখী মানুষ, তাই আপনাকে আনা হয়েছে। ছদরুল ফকির যদি সুখী মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো তাকেও আনা হবে, কিংবা আপনার অফিসের বড় সাহেব।“

যখন আঙ্কেল পুরোপুরি বুঝতে পারলেন তার সাথে কী হতে যাচ্ছে তখন যে হাউমাউ কান্না শুরু করলেন তার জন্য আমি অপ্রস্তুত ছিলাম তা বলা যাবে না। একটা পর্যায়ে এসে সবাই কাঁদে, “আব্বা, আপনারা আমার আব্বাজান। আমি একেবারেই সুখী মানুষ না। আমার জীবনে অনেক কষ্ট। আমার ডায়াবেটিস। আমার বউয়ের বাতের বেদনা। চারটে সন্তান আমার, ইচ্ছে থাকলেও মনে হয় আর একটা নেয়ার সুযোগই পাবো না কোনদিন আর। আমার আম্মা চোখে দেখে না ঠিকমত। আমার বড় ছেলেটা অকর্মার ঢেঁকি হইছে একটা। বড় মেয়ে সারাদিন মোবাইল নিয়া পইড়া থাকে। ছোটগুলার পড়াশুনায় মনোযোগ নাই, ক্লাসে রেজাল্ট খারাপ। আব্বা, আমার জীবনে কোন সুখ নাই। আমারে যাইতে দেন, আল্লাহর দোহাই।“

“কী আশ্চর্য! একটু আগেই তো বললেন আপনি বড়ো ভালো আছেন।“ আমার কথার পেছনে কেদার চোখ রাঙালো, “তখন এক কথা, পরিস্থিতি বুঝে অন্য কথা! আপনাকে তো আমি ভদ্রলোক ভেবেছিলাম।“

“বাবা, এসব করে কী হবে বলো বাবা? কেন শুধুশুধু মানুষরে কষ্ট দিচ্ছ? তোমার মাথায় হয়তো অনেক রাগ, অনেক ঘৃণা। কিন্তু মানুষের উপর নির্যাতন করে তোমাদের কোন লাভ হবে না বাবা।“

“আরে এসব আপনাকে কে বললো?” আমি জবাব দিলাম, “রাগ, ঘৃণা থাকবে কেন? আমাদের প্রজেক্টের কোন বড় ফোকাস নেই বললাম কি না? সুখী মানুষদের আগুনে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাই ছুঁড়ে মারছি। এটা তো সহজ কথা।“

কান্নাকাটি আর বেশিক্ষণ চললো না। জ্বলদগ্নির তাপে আঙ্কেলের মাথায়ও একসময় আগুন জ্বলে গেলো, “এই শুয়োরের বাচ্চারা, তোরা ভাবছিস তোরা পার পেয়ে যাবি? তোরা নিজের মা’রে দিয়ে খানকিগিরি করানোর যোগ্য না কুত্তার বাচ্চারা, তোরা আমারে পোড়াবি? দেশে বিচার আছে, আইন আছে। জীবনে আইন বানান করতে শিখছস শালা খানকির ছেলেরা? পুলিশ ধরে নিয়ে যখন পেছন দিয়ে আলু ঢুকাবে তখন বুঝবি। ক্রসফায়ারে মরবি তোরা কুত্তার বাচ্চারা, ক্রসফায়ারে মরবি।“

“আপনার কথাবার্তা তো অত্যন্ত ভালগার রে ভাই!“ আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম, “এই কথাগুলো ভদ্রভাবে বললে সমস্যাটা কোথায়? আপনার ধারনা আমরা ঘাস খাই? আমার বাবার টাকা আছে, ক্ষমতা আছে। কতটা আছে সেটা আপনার কল্পনার বাইরে। আইন-বিচার আমাকে দেখাবেন না। আমরা অন্য জাত, স্যার। আমি ক্রসফায়ারে মরি না, আমি ক্রসফায়ার করাই। আইনের হাত যতই লম্বা হোক না কেন, পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছুবে না।“

“হারামজাদা খানকির পোলার চাঁদ দেখাচ্ছিস তোরা পাবলিক জানলে তোদের শরীর থেকে হাত-পা গুলো ছিঁড়ে ফেলবে।”

“এটা আঙ্কেল বাড়িয়ে বলছেন।“ আমি হেঁসে উঠলাম, “পাবলিক তো জানে! আমরা আর কী করছি, এরচেয়ে ভয়ানক কাজকর্ম হচ্ছে না? মানুষজনের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই এসবের পেছনে ছুটবে।“

এসময় দরজায় আবার টোকা পড়লো। টোকা তো না, পড়লো থাবা। হাতের আঘাতে লোহার দরজায় ধুম করে একটি শব্দ হলো, তারপর কিছুক্ষণ পরপর শব্দ হতেই লাগলো। দরজা না খোলা পর্যন্ত এ শব্দ বন্ধ হবে না। এধরনের কোন সংকেত আমার জানা নেই। আমি আঙ্কেলের মুখ চেপে ধরলাম, যাতে কোন শব্দ করতে না পারেন, “কেদার, কে এসেছে দেখ। ছুড়িটা তোলে নাও।“

কেদার মেঝে থেকে তার চকচকে অস্ত্রটি তুলে নিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রেখেই আঁতকে উঠলো, “স্যার, ঝামেলা হয়েছে।“

“কী ঝামেলা হয়েছে?”

“বড় স্যার দাঁড়িয়ে আছেন।“

কেদার একজন মানুষকেই বড় স্যার বলে, তিনি আমার বাবা। আমাদের কাজ সম্পর্কে বাবা কিছু জানতেন না, কিন্তু এখন নিশ্চয়ই জানেন। সম্ভবত আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছিলেন, সে সূত্র ধরে এখানে এসে পৌঁছেছেন। বাবা কখনও আমার বিরুদ্ধে কিছু করবেন না আমি জানি, কিন্তু তাকে বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখার সাহস আমারও নেই, “দরজা খোলে দাও, আর তাড়াতাড়ি হাতের জিনিসটা নিচে ফেলো।“

কেদার দরজা খুলে দিলো, বাবা ভেতরে ঢুকলেন। তাকে যদি সুতোর সাথে তুলনা দিই তবে বলতে হবে এই সুতোর কিনারা আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। লাখটাকার স্যুট আর গোল্ডরিম চশমা পরলেই এই গাম্ভীর্য আর আভিজাত্য কেউ অর্জন করতে পারেন না। নিজের চারপাশে দম্ভ, অর্থ ও ক্ষমতার যে দেয়াল তিনি বানিয়ে রেখেছেন তা আজ পর্যন্ত কেউ ভেদ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তবু, সে দেয়ালের ইটের ফাঁকে উঁকি দিলে বাবার কিছু খেয়াল চোখে পড়ে যায়। ছোটবেলায় একবার বাবার ব্যক্তিগত আলমারি ঘাটতে গিয়ে একটা দলিল খুঁজে পেয়েছিলাম। সে দলিলে স্পষ্ট লেখা ছিলো এই দেশ ত্রিশ লক্ষ ছিয়াশি হাজার টাকায় বাবার নামে লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে। এর নিচে যাদের স্বাক্ষর ছিলো তাদের কয়েকজনের নাম আমি ওই বয়সেও জানতাম, প্রধানমন্ত্রীর-রাষ্ট্রপতির নাম স্কুলে না শেখার কোন উপায় তো ছিলো না।

কোন খেয়ালে বাবা এ নকল দলিলটি তৈরি করে রেখে দিয়েছিলেন আমি জানি না, কিন্তু যে জ্ঞান নিয়ে সেই বাল্যকাল থেকে এতদূর এসেছি সে জ্ঞান কি চাইলেও একেবারে মুছে ফেলা যায়?

বাবা কখনও মাথা গরম করেন না, তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ঘরের সবকিছু একবার দেখে নিলেন। ঘরের মাঝে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড, চেয়ারে বাঁধা একজন মানুষ, মেঝেতে রাখা চায়ের কাপ আর কোকের বোতল, ভাঙা রিভলভিং চেয়ার, স্টেইনলেস স্টিলের ছুড়ি, কাঁচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকা কেদার, হতভম্ব আমি।  স্তম্ভকে কোন কিছুই স্তম্ভিত করতে পারে না, চশমার পেছনে তার চোখদুটোর যেন ভুল করেও অবাক হওয়ার ক্ষমতা নেই, “এই চলছে তাহলে? প্রতিদিন? তুমি যে একটা আনকালচারড আনসোশ্যাল রাস্কেলে পরিণত হয়েছ তা বুঝতে পারছ? তুমি জানো তোমার মা যদি জানতে পারে তাহলে কী অবস্থা হবে? সে চিন্তা করেছিলে?”

বাবা কেদারের দিকে ফিরলেন। কেদার যখন আমাদের বাড়িতে প্রথম আসে তখন আমি অনেক ছোট। ওর কাজ ছিলো চোখ বন্ধ করে আমার সব কথা শোনা। আমার সাথে স্কুলে যেতে বললে স্কুলে যাওয়া। আমার সাথে খেতে বললে খাওয়া। আমি পা টিপে দিতে বললে পা টিপে দেয়া। যদি আমি চাই তাহলে আমার সামনে নগ্ন হয়ে দাড়িয়ে থাকা। আমি রক্ত দেখতে চাইলে হাত কেটে রক্ত বের করা। কেদারের নিজের কোন ইচ্ছে যে নেই তা বাবা জানতেন, তাই ওর উপর কোন অভিযোগ তিনি করলেন না, “এ গরম সহ্য হচ্ছে না। কেদার, আগুন নেভা।“

আমি কথা বলার শক্তি-সাহস-স্পর্ধা সব হারিয়ে ফেলেছি। বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন, “তুমি নির্লজ্জের মত একটা কাজ করবে সেটা আমি চিন্তাও করতে পারি নি। তোমার সাহস কত হয়েছে যে তুমি ভাবছ আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার তোমার আছে?”

“কিন্তু আমি তো তেমন কিছু করি নি।“

“কর নি মানে? তুমি কোন সাহসে শিউলিমালাকে এখানে ধরে এনে পুড়িয়ে মারার ভয় দেখিয়েছ? I admit, I slept with her. মেয়েটা অন্যরকম, ওর প্রতি আমার একটা আকর্ষণ জন্মেছিলো। She never refused. এটা নতুন কিছু নয়, আগেও ঘটেছে। তোমার মা’ও খুব ভালো করেই জানে। হ্যাঁ, সে কষ্ট পেয়েছে কিছুটা। কিন্তু আমার কমিটমেন্ট সবসময় তার প্রতিই ছিলো, those were just physical necessity. তুমি আমার ছায়ায় বড় হয়েও এত নোংরা একটা কাজ করবে তা আমি ভাবতে পারি নি।“

মা যা জানে, আমিও তা জানি। জানার পর হয়তো তার উপর ঘৃণা জন্মানোর কথা ছিলো, কিন্তু জন্মায়নি। সাম্রাজ্যের ইতিহাস কখনও বিশুদ্ধ হতে পারে না। বাবাকে আমি কখনও নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখিনি, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আমার করার নেই। তবু মাঝে মাঝে সবাই ভুল করে। অনেক বছর আগে মা’য়ের দিক থেকে আমার দুঃসম্পর্কের এক বোন আমাদের বাড়িতে থাকতে এসেছিল, বয়সে আমার বেশ বড়ই হতো সে। সারাদিন ওর সাথেই ছুটোছুটি করতাম আমি। কেদারকে তখনও নিয়ে আসা হয়নি, বড় হলেও ওই একজনই ছিলো আমার খেলার সাথী। যখন হঠাৎ একদিন সে আর রইলো না তখন আমি কান্নাকাটি করেছিলাম খুব। প্লেট ছুড়ে ভেঙে ফেলেছিলাম ডাইনিং টেবিল থেকে। কিন্তু কেদারকে নিয়ে আসা হলো, আমি অতীতের কথা সব ভুলে গেলাম। আসলে, আমাদের বাসায় এত বাড়তি প্লেট ছিলো যে এক দু’টো ভাঙলে কিছুই যায় আসে না।

ঐ দুঃসম্পর্কের বোনের নামটা আমার মনে না থাকলেও তা শিউলিমালা হতে পারে না। কারণ Sheulimala never refused. মেয়েটি কে তা আমি এখন অনুমান করতে পারছি, “শিউলিমালা কি খাটো করে শ্যামলা সবুজ শার্ট পরা মেয়েটা? যাকে আমি এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলাম।”

“সবুজ শার্ট পরা কি মানুষের পরিচয় হতে পারে?”

“বাবা, ওই মেয়েটাকে আমি চিনতাম না, বিশ্বাস কর। ওর সাথে তোমার পরিচয় আছে তাও আমি জানতাম না।“ আমি বাবার হাতদু’টো ধরলাম, “আমি তোমাকে ছুঁয়ে বলছি। Believe me, dad. I swear I didn’t know who she was.”

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “সত্যিই জানো না বলছ?”

“হ্যাঁ বাবা, সত্যি।“

“আমি অবশ্য এমন একটা কিছুই অনুমান করেছিলাম। তুমি মানসিক ভাবে পুরোপুরি ঠিক নও, কেন এমন হলো আমি জানি না। কিন্তু নোংরামি জিনিসটা আমার ছেলের মাঝে থাকতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। তবুও, তুমি একটা ভয়ানক ক্রাইম করে ফেলেছ। তুমি কেন করেছ আমি জানি না, কিন্তু তুমি নিজের হাতে এই অপরাধগুলো ঘটিয়েছ। নিরপরাধ মানুষ মারা গেছে। এর শাস্তি তোমার পেতে হবে। এ কাজ আজ থেকে বন্ধ। আর তোমার শাস্তির ব্যবস্থা বাড়ি গিয়ে করছি।“

কেদার আগুন নিভিয়ে ফেলেছে ততোক্ষণে। বাবা চেয়ারে বাঁধা আঙ্কেলের দিকে ফিরলেন, “দেখুন, ছোট মানুষ, ভুল করে ফেলেছে। ওরা আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। লোক জানাজানি হলে আপনার-আমার দু’জনেরই সমস্যা, সুতরাং তার কোন প্রয়োজন নেই।“

“স্যার, ওরা আমাকে আগুনে পুড়িয়ে…”

“মজা করে ভয় দেখিয়েছে, পোড়ায়নি তো আর। আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি, বাড়ি চলে যান। কেদার, বাঁধন খুলে দে।“

আঙ্কেল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু তার দাঁড়ানোতে ভরসার কোন চিহ্ন আমি দেখতে পেলাম না। কুঁজো হয়ে হেঁটে তিনি বাইরে চলে গেলেন, একটিবারের জন্য পেছনে ফিরে তাকালেন না। এই হাঁটার ভঙ্গিমাটা তাকে দারুণ মানিয়েছে বলতে হবে। আমার মনে হয় তিনি সবসময় কুঁজো হয়েই হাঁটেন। মাঝে মাঝে দেখা যায়, মাঝে মাঝে দেখা যায় না। আমার আর কিছু বলার ছিলো না। কেদার কেবল প্রশ্ন করলো, “বড় স্যার, এভাবে যেতে দিলেন?”

“কিছু হবে না। দু’দিন পরই সবকিছু ভুলে যাবে। এই মানুষদের নিয়ে কোন ভয় নেই।“

চায়ের দোকানের ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে দূরে, কাপগুলো ফিরিয়ে নিতে আসছে। ছোট মানুষ। আমরা কাল থেকে আর থাকবো না, কিন্তু আমার ধারনা আরও কয়েকদিন ও চা নিয়ে আসবে। বাবা বললেন, “আর শিউলিমালাকে নিয়ে চিন্তা করো না। পিক্যুলিয়ার মেয়ে। ওর তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।“

আমার কেন যেন মনে হলো আমি আগুনে শিউলিমালাকেই বারবার ছুড়ে ফেলেছি।

The cover photo used is Edvard Munch's self portrait in hell. Munch was famous for his expressionist form of artworks.