শেষরাত্রি
আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলাম।
অপেক্ষা করছিলাম অনেক আশা নিয়ে। এই বর্গাকৃতির শূন্য ঘরে সামান্য সান্নিধ্য খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছি বহু আগে। ভোরবেলা ঘরের বাইরে পাখিদের কিচির মিচির শোনা যায়, সন্দেহ হয় সত্যিই তা শুনলাম কি না। হয়তো পাখিরা কিচির মিচির করে না, স্মৃতি আমাকে এতটাই ধোঁকা দেয় আজকাল যে অবাস্তব কোন শব্দ আমি কল্পনা করি। পাখি বলতে কিছু নাও থাকতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। মাঝে মাঝে বিশ্বাস হতে চায় না একটা প্রাণী আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, বাতাসে ডানা মেলে ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষের মত গৃহবন্দী প্রজাতির পদচারণ যে গ্রহে তাতে মুক্তির উচ্ছ্বাস অনুভব করার ধৃষ্টতা পক্ষীকুলের একটি জ্ঞান-বুদ্ধিহীন সদস্য আদৌ কি দেখাতে পারে?
জ্ঞান-বুদ্ধির প্রসঙ্গ যেহেতু এলো, আজকাল আমার নিজের সম্বল নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। রূপকথার গল্প পড়েছিলাম ছেলেবেলায়। পক্ষীরাজ ঘোড়া, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, হিংসুটে সতীন আর দিঘির নিচে রাক্ষসের প্রাণ-ভোমরা সবই কিছু কিছু মনে করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কথা মনে আছে। এখন হঠাৎ কোন দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, সত্যিই কি এরা ছিলো নাকি আমার মনের কল্পনা। হয়তো মনে মনে এ কাহিনী, ও ভাষা আমিই সৃষ্টি করেছি। মনে হয় আমিই রবীন্দ্রনাথ।
স্কুলে পিথাগোরাসের উপপাদ্য পড়তে হতো আমাদের। অঙ্ক স্যারের নাম ছিলো জালালউদ্দিন, তার বেতের ভয়ে উপপাদ্য জাতীয় সংগীতের মত মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। তার হাড়-চামড়ায় কী আছে কখনও বোঝার চেষ্টা করি নি। কলেজে ওঠে সায়েন্স ছেড়ে দেওয়ার পর প্রয়োজন একেবারেই ফুরোলো। তবু মস্তিষ্কের কোনো খেয়ালে পিথাগোরাসের ‘গান’টা আমার আজও মনে আছে। তাতেও সন্দেহ হয়, সত্যিই এরকম কিছু আছে তো নাকি সব আমার কল্পনা? কাগজে লিখে অঙ্কটা আমি আজকাল মেলানোর চেষ্টা করছি। এক বাক্য প্রমাণ করার জন্য দশ বাক্য প্রমাণ করতে হয়, স্কুলে মুখস্থ করে গণিত পাশ করা ছাত্রের পক্ষে কাজটি মোটেও সহজ নয়। তবু আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ যেদিন প্রমাণ হয়ে যাবে, সেদিন আমি নিশ্চিত হতে পারবো পিথাগোরাস ছিলেন, তার উপপাদ্য এখনও ছেলেমেয়েরা মুখস্থ করে চলেছে।
আমার ঘরটি চিলেকোঠা। আলোবাতাস আসে না তেমন। তবু মাথার ওপর ফ্যানটা ঠিকমতই ঘুরে, এদিকে লোডশেডিং খুব একটা হয় না। গরমকালে যা একটু কষ্ট, শীত-বর্ষায় ঠাণ্ডা বাতাসে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ভালোই লাগে। কিছু কিছু দিন গরমটা আর সহ্য করা যায় না, তখন ছাদে গিয়ে দাড়াই। বাড়িটা ঢাকার তুলনায় ছোট, মাত্র দু’তলা। যথেষ্ট পুরনো হয়েছে, ঘরের রঙ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। পাড়াটাই অতীতের, বিশ-ত্রিশ বছর আগের আর্কিটেকচার এখনও পুরোপুরি মুছে যেতে পারেনি। তবু তার ফাঁকে ফাঁকে দশতলা-পনেরতলা বিল্ডিঙগুলো বুর্জোয়ার মত দাড়িয়ে গেল। আরও হবে, আমার মার চাচার করা এ বাড়িটাও রইবে না।
ছাদের কথা বলছিলাম। একরকম স্টোররুমই হয়ে গেছে ছাদটা, দুনিয়ার জঞ্জাল, ভাঙা আসবাব, নষ্ট যন্ত্রপাতির ঠাই হয়েছে এখানে। এদের সাথে আমার বসবাসটাও বেশ সার্থক মনে হয়, আমিও ওই অকেজো মানুষ কি না। অথচ কি সুন্দর একটা জায়গা হতে পারতো এটা। কিছু ফুলের গাছ থাকতে পারতো, একটা ছাউনি, দু’টো বেতের চেয়ার। বিকেলের নরম রোদে চা খাওয়ার মোক্ষম স্থান। লাগোয়া টয়লেটও আছে একটা, যার কারণে আমার নিচে যাওয়ারও কোন প্রয়োজন পড়ে না আজকাল।
সবকিছুই ঠিক ছিলো, কিন্তু তেমন সৌখিন মানুষটি হবে কে? মা’র চাচাতো ভাই মানে মামার সংসার খুব বড়, পুরো দু’তলায় তাদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সংসারে কর্মক্ষম লোক বলতে মামা নিজে, তার চাকরিটা খুব একটা প্রচার করার মত কিছু নয়। তার বড় মেয়ে পাড়ার একটা স্কুলে পড়াতো, কিছুদিন আগে মুক্তাআপুর বিয়ে হয়ে গেছে। নিচতলাটা একটা প্রেস ভাড়া নিয়েছে বাঁধাই করার জন্য, সে কল্যাণেই কিছুটা টাকা-পয়সা পরিবারে যুক্ত হয়।
আমার খাবার নিয়ে আসে ঝর্ণা। আমি যতক্ষণ খাই ততক্ষণই পাশে বসে থাকে, কথা বলে “আহারে, বাপ-মা মরা পুলাটার লাগি কারও মনে মায়া দয়া নাই। হাজার হোক মামা, ক্যামনে একলা ঘরটাত ফালায়া রাখছে। কেউ একবারও দেখবার আসে না।“
“তুমি আসলেই হবে।“
আমার কথা শুনে ঝর্ণা লজ্জা পায়। কেন পায় অনুমান করতে পারি। মাঝে মাঝে মনে হয় একবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেই, কিন্তু প্রশ্নটা কখনও করা হয় না। ক্যান্সার প্রতিদিন একটু একটু করে আমাকে শুষে নিচ্ছে। শরীর ছিবড়ে হয়ে গেছে, চিন্তার নেই ঠিক। শুধুশুধু আরেকজন মানুষকে জড়িয়ে লাভ কী?
না, সত্যি কথাটাই বলি। এতদূরের চিন্তা আমি করি না। ঝর্ণা আমার কথার মানে বুঝতে পারে না। আমি যখন বলি ‘তুমি আসলেই হবে’, তার অর্থ হচ্ছে যে কোন একজন হলেই হলো। শুধু খাবারটাই তো দিয়ে যাওয়া, একবার খোঁজ নেয়া বেঁচে আছি না মরে গেছি। সে কাজ ঝর্ণা করে নাকি গলির মোড়ের চায়ের দোকানের গোঁফঅলা দোকানী করে তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
তবু যদি একজন মানুষ বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো আমার কাছে তাতেই বা কী? আমার শরীর-মনের সে সাহসটুকু করার ক্ষমতা অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। অথচ, বয়স আর কতই হবে? ঝর্ণার থেকে তিন বছর বেশি বড়জোর। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরুলাম সে মনে হয় তিন-চার বছর হলো। টিউশনি করে চলছিলাম, খারাপ চলছিলো না। কোন পিছুটান নেই, আমার ওপর নির্ভর করার মতও কোন মানুষ ছিলো না। মা মারা গেছে বহুদিন আগে। বাবা মরলো পড়াশুনার মাঝে, ঐ ক্যান্সারেই। তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে এক বছর নষ্ট হয়েছিল। তখন একটু দুঃখ (আর গোপনে বলি, সামান্য রাগ) হতো, এখন আমি তাদের ঊর্ধ্বে চলে গেছি। কেবল মনে হয়, বাবার ক্যান্সার আর কয়েকটাদিন অপেক্ষা করলেও পারতো। বাপ-ব্যাটার একসাথে ধরা পড়লে ভালোই হতো, দু’জন একসাথে পড়ে থাকতাম।
আমার এ রোগ যখন ধরা পড়লো তখন আমি ছোটখাটো চাকরির চেষ্টা করছি। পেয়েও যেতাম সম্ভবত। মেসে থাকি, তিন-চারটে টিউশনি করাই, ব্যাচেলর মানুষের আর কী লাগে? আগের জীবনটাও একেবারে বিফল কাটেনি। দু’দুটো প্রেম করেছি, পলিটিকাল পার্টিতে কর্মী হিসেবে নামটাও যুক্ত হয়ে ছিলো। পৃথিবী এরকম অপদস্থ করবে আমাকে ভাবতেই পারিনি। একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম, পাশার দান উল্টে গেলো। টিউমার ছিলো একটা মাথায়, কোনভাবেই সারানোর উপায় নেই।
প্রথম কিছুদিন সবকিছু ঠিকমত বুঝতে পারি নি, মনে হচ্ছিল ঘোরে আছি। ঘোরটা যখন কাটলো, তখন বিছানায় স্থায়ী শয্যা নিলাম। কোথাও যাই না, বের হই না, কারও সাথে কথা বলি না। ওদিকে মেসে আমার সাথে থাকাও অন্যদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। অসুস্থ মানুষ, খেয়াল রাখার কেউ নেই। হঠাৎ করে মারা গেলেও সমস্যা। ওরাই অনেক চেষ্টাচরিত্র করে আমার এই মামার নাম বের করলো, তারপর হাতে পায়ে ধরে মামাকে রাজি করালো। তারপর একদিন এ বাড়ির চিলেকোঠায় আমি জায়গা নিলাম।
ঝর্ণা যা বলে বলুক, মামার ওপর আমার কোন রাগ নেই। টানাটানির মাঝে আমাকে যে থাকতে দিয়েছেন তাই আজকাল কে করে? শান্তিতে ঘুমচ্ছি, প্রতিদিন খেতে পারছি। ব্যাংকে আমার কিছু টাকা ছিলো, খরচের জন্য সেগুলোও মামীকে দিয়ে দিয়েছি। ঝর্ণা মামীর খালাতো কিংবা ফুফাতো বোন, সেও এ বাড়িতে থাকে, কাজটাজ করে দেয়। মামী তাকে দায়িত্ব দিয়েছে আমার খেয়াল রাখার জন্য। এ আদেশের কোন বরখেলাপ হয়নি আজ পর্যন্ত। যদিও ঝর্ণা মাঝে মাঝে এসে ঘ্যানঘ্যান করে ওষুধ কিনে খাওয়ার জন্য, আমি বিরক্ত হই না। বোকা মেয়ে এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না যে ফাঁসির আসামীরও বাঁচার সম্ভাবনা আমার চেয়ে বেশি। কষ্ট হবে, তবু এত টাকা দিয়ে কিছু অনর্থক কেমিক্যাল কেনার কোন মানে আমি খুঁজে পাই নি।
চিলেকোঠার শুরুর দিনগুলো অসহ্য লাগতো। মাঝে মাঝে ভাবতাম, নিকুচি করি ক্যান্সারের। দু’তলা থেকে লাফ দেই নিচে, সবকিছু চুকেবুকে যাক। কিন্তু কাজটা করা হয়নি। হাজার হোক দু’তলা, কতটুকুই বা উঁচু হবে? যদি না মরি তাহলে হাত-পা ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। এখন তো তাও নড়তে-চড়তে পারি, শরীরের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আছে। তখন তাও থাকবে না। যদি পাঁচতলা হতো তাহলে সম্ভবত অপেক্ষা করতাম না। এই অসম্ভব বিরক্তিতে ভুগতে হতো না।
বন্ধুবান্ধব নেই আমার। ছিলো, অনেকজনই ছিলো। তাদের সাথে সিগারেট খেয়েছি, শখ করে কয়েকবার মদও পড়েছে গলায়। যেদিন টিউশনি থাকতো না সেদিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতাম। একবার কয়েকজন মিলে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলাম। সময়টা খারাপ ছিলো, গিয়ে পড়লাম ঝড়ের মধ্যে। ভ্রমণ উঠলো লাটে, তবে মজা একেবারেই কিছু হয়নি তা বলবো না। আজ সবাই হারিয়ে গিয়েছে। না, ওদের দোষ দিচ্ছি না। আসলে আমার অবস্থার কথা কেউ জানে না। মোবাইল ফোনটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে মাসের পর মাস। যারা জানে তারা আমি কোথায় থাকি তা বলতে পারে না।
কবিরের কথা মনে আছে স্পষ্ট। হ্যাংলা-পাতলা ছেলে, কথায় আঞ্চলিক টান এতটাই ছিলো যে ফার্স্ট ইয়ারে ও কী বলছে তাই আমরা সহজে বুঝতে পারতাম না। আস্তে আস্তে ওর ভাষাও পাল্টালো, আমাদের অনুধাবন ক্ষমতাও বাড়লো। কবিরের কানেকশন ছিলো ভালো। মামা-চাচা নয়, খালার জোরে বের হয়েই চাকরি হয়ে গেলে তার। তারপর বিয়ে করেছে, তার শ্বশুরবাড়ির ছাদে ঝুলতে থাকা কাপড় এ বিল্ডিং থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সেভাবেই কেমন করে জানতে পেরে কবির একদিন দেখা করতে এসেছিলো।
টিংটিঙে ছিলো বলে আমরা ক্ষ্যাপাতাম ওকে একসময়। এখনও তার স্বাস্থ্যের কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, কিন্তু আমার ওজন কবিরের থেকেও কমে গেছে। তবে ভাষাটা পাল্টে গেছে কীভাবে যেন, মাঝে মাঝে দু-একটা শব্দ হোঁচট খেলেও কবিরের মুখ থেকে মালিশ দেয়া শহুরে বাংলাই বের হচ্ছিল।
“এ কী অবস্থা হয়েছে?”
“ক্যান্সার। নাদুস-নুদুস হওয়ার কোন সুযোগ তো নেই।“
“চিকিৎসা করাচ্ছিস না?”
“এ জিনিস সারবে না। শুধু শুধু টাকা খরচ করে লাভ আছে? তাছাড়া, টাকা আসবে কোথা থেকে? দেখছিস না, অন্যের বাড়িতে পড়ে আছি। খাই-দাই, ঘুমাই।“
“সারাদিন এখানেই শুয়ে থাকিস?”
“হ্যাঁ।“
“কেমন করে? কী ভয়ানক গরম এখানে, আমি তো এখনই ঘামতে শুরু করেছি।“
“আমার আর কাজ কী? ঘামলে ঘামি, সেটাও খারাপ লাগে না। অন্তত, কিছু তো হচ্ছে। এছাড়া আর কি ই বা করার আছে? মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে দাড়াই, এতটুকুই।“
“সময় কাটে কেমন করে?”
আমার হাসি পেয়েছিলো, “জেলখানায় ফাঁসির আসামীর যেভাবে কাটে। সময় চলে যায়, খেয়াল থাকে না। এই গরমটা আছে বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, অজ্ঞান হয়ে যাই। শরীর তো দুর্বল হয়েই আছে। এর বাইরে কিছু আসলে আজকাল টের পাই না। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটে।“
কথাটা মিথ্যা নয়। আজকাল আমি দিনের বারো ঘণ্টাই ঘুমাই। রাতে ঘুম, দুপুরে ঘুম, সন্ধ্যায় ঘুম। শরীর সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে, সময় হলেই চোখ বুজে আসে। আমি চোখকে বাঁধা দিই না, তন্দ্রার জগতকে হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাই।
কবির বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলো না, আমার উৎসাহহীন জবাব ওকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছে যে তা আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কী ই বা করার ছিলো আমার? জোর করেও আজ কোন উৎসাহ মনের মাঝে আমি জন্ম দিতে পারি না। কিছু করতে ইচ্ছে হয় না, কথা বলতে কষ্ট হয়। কবির জিজ্ঞেস করলো, “কী চিন্তা করিস?”
“চিন্তার কোন শেষ আছে নাকি? এই যে দেখছিস ফ্যানটা, এটা নিয়ে চিন্তা করি। হাতগুলো যখন বনবন করে ঘুরে তখন ওগুলোকে আলাদা করে তো আর দেখা যায় না। তবু তাকিয়ে থাকি মাঝে মাঝে, যদি টের পাওয়া যায় ঠিক কোথায় একটা হাত এখন আছে। কালকে কৈ মাছ খেয়েছিলাম, সেটা নিয়েও চিন্তা করি। এর আগে কবে খেয়েছিলাম, সত্যিই খেয়েছিলাম কি না। এই যে তুই গলায় টাই পড়েছিস, তাতে যে গোল গোল ফুটকিগুলো সেগুলো নিয়েও চিন্তা করবো নিশ্চয়ই। এক-দুইমাস পর মনে করার চেষ্টা করবো ডিজাইনটা ঠিক কেমন ছিলো, কয়টা বৃত্ত ছিলো, ছোট না কি বড় এসব।“
ঝর্ণা চা নিয়ে এসেছিলো, কবির কয়েকটা চুমুক দিয়েই পালালো। কী আশ্চর্য, ও চলে যাওয়ার পর একটু দুঃখই হচ্ছিলো। দুঃখটা আবার ভালোই লাগছিলো, অন্তত কিছু তো টের পাচ্ছি। মাঝে মাঝে রাতের দিকে ঝর্ণা এসে আমার দরজার পাশে দাড়িয়ে থাকে। আমি টের পাই, কিছু বলি না। ওইদিনও দাড়িয়ে ছিলো, পাশের বাড়ির জানালার আলো ওর লম্বা ছায়াটা আমার ঘরের মাঝে ফুটিয়ে তুললো প্রতিদিনের মত। দুঃখের অনুভূতিটা ফেরত পেয়ে মন ভালো ছিল কি না, তাই জিজ্ঞেস করলাম, “ঝর্ণা?”
“জে।“
“তুমি কিছু বলবে?”
ও সাথে সাথেই উত্তর দিতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ্যের পর প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনে কিছু চান?”
আমি কী কিছু চাই? একসময় হয়তো বাঁচতে চাইতাম, আমি একটু ভেবে দেখলাম এখন সে ইচ্ছাটিও নেই। আমি সম্ভবত কিছুই চাইনা। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে, কিন্তু সেদিন আলাদীনের দৈত্যকে হাতে পেলেও আমি কিছু চাইতে পারতাম না।
জবাব দিলাম, “আজ আমি কিছু চাই না। হয়তো অন্যকোন দিন চাইতে পারি। দেখা যাক।“
আরও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ঝর্ণা চলে গেল। সেদিন ভোররাতে স্বপ্ন দেখলাম আমার পানির গ্লাসটা ঘষতেই তা থেকে একটা জবড়জং দৈত্য বের হয়ে এলো। দৈত্য হাড়গিলে আর মিশমিশে কালো। তার চোখে লাল ফ্রেমের কাঁচের চশমা। স্বপ্ন তো আর সত্যি নয় যে চুলের রঙ ঠোঁটের কোণের তিল চোখে পড়বে, কিন্তু যতদূর মনে পরে দৈত্যটার চোখমুখ মোটিভেশনাল স্পিকারদের মত চকচক করছিলো। সে জিজ্ঞাস করলো, “বল, কী চাও?”
“যা চাই তাই পাবো?”
“তাই পাবে মানে? এটা কী মগের মুল্লুক নাকি? আজকাল এত দরাজ হলে চলে না, বুঝলে। আমাদের সিস্টেম আপগ্রেড হয়েছে অবশ্য, ভালোবাসা-টালোবাসা চাইলে আজকাল সেটাও ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু এখন ধর তুমি একেবারে বিশ্বশান্তি চেয়ে বসলে, সে কী আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব?”
“তাহলে উপায়?”
“উপায় হচ্ছে আমাদের সংবিধানটা একটু ভালো করে পড়ে নেয়া। তবে তুমি আধমরা মানুষ, ও ঝামেলায় যেতে হবে না। কিছু একটা চাও, সম্ভব হলে চুপেচাপে দিয়ে যাবো খন। আজকাল সংবিধান প্রণেতারাই সংবিধানকে এক পয়সা গুণে না, আর আমরা একটু হাত-বেহাত করলেই দোষ?”
“ধন্যবাদ। তো, তিনটা ইচ্ছা করা যাবে তো?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই! ও তো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের কালচার। আদ্যিকাল থেকেই জ্বীন-দৈত্যেরা তিনখান ইচ্ছা পূরণ করে আসছে, এখন করছে, ভবিষ্যতেও করবে। আলাদীনের প্রদীপ থেকে উপেন্দ্রবাবুর ভূতের রাজা, মিনার কুপি থেকে তোমার পানির গ্লাস এসব পাল্টাবে। কিন্তু তিনের কোন পরিবর্তন হবে না।“
স্বপ্নে কোন চিন্তা করতে হয় না, আমি সাথে সাথে চেয়ে বসলাম, “আমি চাই পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।“
“ওরেব্বাস, প্রথমেই তো আপদে ফেলে দিলে বাবা। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, অনুরোধ ফেলতেও পারি না তোমার। ঠিক আছে, পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হলো।“
“দ্বিতীয়ত আমি চাই পৃথিবীর সকল প্রাণী দুঃখী হোক।“
“তাও হলো।“
“আর সবশেষে চাই, আমার মৃত্যু হোক।“
“একেবারে মৃত্যু, আরও কয়েকটা দিন ভেবে দেখলে হতো না? মানে ধর ধনুক নিয়ে রাজা শিকারে গেলো। ঐ ঝোপের ফাঁকে হঠাৎ কিছু একটা নড়তে দেখে হরিণ ভেবে যদি তখনই সড়াৎ করে তীর মেরে দেয় তাহলে তো সমস্যা। পরে দেখা যাবে ও ছিলো কোন এক তপস্বী, অভিশাপ দিয়ে একেবারে নাকাল করে ছাড়বে তখন। তীর একবার যদি হাতছাড়া হলো তাহলে তো ওটিকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।“
“তাহলে কী করি?”
“আমি বলি কী, কিছুদিন চিন্তাভাবনা করে দেখ। যদি দেখলে মরতে আর ইচ্ছে হচ্ছে না তাহলে তো সব চুকেবুকেই গেলো। আর নয়তো এ কবিতাটা আবৃত্তি করবে একবার, তাহলেই কেল্লা ফতে! নির্ঘাত মৃত্যু।“
ট্যাঁশ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে,
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে;
মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়,
মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়।
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে;
মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়,
মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়।
“আরে, এ ছড়া তো আমি পড়েছি! সুকুমার মিত্রের ছড়া।“
“সুকুমার রায়।“
“যেমন মিত্র তেমন রায়। সে কথা থাকুক, আপনি দৈত্য হয়ে নির্লজ্জের মত অন্য মানুষের ছড়া চুরি করলেন?”
“আহা, চুরি বলছ কেন? আমি কি এ দাবি করেছি নাকি যে এটা আমার লেখা। তাছাড়া, এমনি এমনি তো কবিতাটা বাঁছিনি। তোমরা তো সবাই ট্যাঁশ গরু, এর চেয়ে মোক্ষম সাহিত্য হবে কী?”
আমি এখন পর্যন্ত লাইন চারটে আবৃত্তি করি নি। সময় খুঁজছি। ভোররাতের স্বপ্ন সত্যি হয়েও যেতে পারে। .যদিও আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছি, তবু এখনও সবকিছু ছেড়ে দিতে পারবো না। কিছু রহস্য এখনও সমাধান করা হয় নি। পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প কী আমি পড়েছিলাম? পিথাগোরাসের উপপাদ্য কি সত্যি? আমিই কি রবীন্দ্রনাথ? এ প্রশ্ন তিনটা আমাকে এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। যেদিন এদের উত্তর জানা হয়ে যাবে, সেদিন আমার আর কিছু করার থাকবে না।
একটা ছোট আশা আছে আমার যে মৃত্যুটা অন্তত সাদাকালো বিরক্তিকর হবে না। যার জন্য এতদিন ধরে আগ্রহভরে অপেক্ষা করছি সে আমাকে হয়তো নিরাশ করবে না। সে দিনটি হবে স্পষ্ট, অর্থবহ, অবিস্মরণীয়। কেমন হবে আমি মাঝে মাঝে কল্পনা করার চেষ্টা করি।
যেমন ধরা যাক, ঘুম থেকে ওঠে দেখলাম কবির আমার চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা সবাই। সেখানে মেহেরুবাও থাকবে, কলেজে থাকতে যার সাথে খুব ভাব ছিলো আমার। সে এখন ডাক্তার, হাতে একটা রিপোর্ট নিয়ে চিৎকার করতে করতে বলবে, “সব ইরেসপন্সিবল এরা! কোথা থেকে টেস্ট করিয়েছিলে তুমি? যত্তোসব লিখে দিয়েছে। তোমার ক্যান্সার-ট্যান্সার কিছু হয়নি। সামান্য রোগ, একমাস হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করলেই সেরে যাবে। Nothing to worry about. আমি ব্যবস্থা করে দেবো, তুমি সরকারি হাসপাতালেই বেড পেয়ে যাবে। কোন টাকা-পয়সা লাগবে না।“
এর চেয়ে বড় খবর আর কী হতে পারে। সবগুলো খুশিখুশি মুখের মাঝে বসে আমিও হাসতে হাসতে দৈত্যের দেয়া কবিতাটা আবৃত্তি করবো, আর সাথে সাথে মারা যাবো। ক্যান্সারে ভুগে নয়, মন্ত্রের জোরে।
আবার মনে হয় আমার মৃত্যু হবে মধ্যরাতে। সেদিনও ঝর্ণা দরজার পাশে দাড়িয়ে থাকবে। আমি জিজ্ঞেস করবো, “ঝর্ণা, কিছু বলবে?”
“আপনে কিছু চান?”
আমি আবার চিন্তা করবো। আমার ভবিষ্যতেও সম্ভবত কিছু চাওয়ার থাকবে না। কিন্তু মৃত্যুর দিনটি তো প্রতিদিনকার মত সোজাসাপ্টা সরল হতে পারে না। যদি একটা মানুষের জীবনও এলোমেলো করে দিতে পারি তাই বা কম কী? আমি উল্টো প্রশ্ন করবো, “আমি কিছু চাই না। তুমি কি কিছু দিতে চাও।“
ও ঘরে ঢুকে আমার বিছানার ওপর বসবে। তারপর কী হবে কে জানে। আমি কেবল বলতে পারি একসময় না একসময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি বলবো।
ট্যাঁশ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে,
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে;
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে;
ঝর্ণা টেরও পাবে না আমি কখন মারা গেছি। আমি অদৃশ্য হয়ে দেখতে পাবো আমার দেহটা শুয়ে আছে, আর মৃত্যু এসেছেন আমাকে সঙ্গে নিতে। তার গায়ে জমকালো এক আলখাল্লা, হাতে ধরা এক মোমবাতি। আমার কেন যেন মনে হয় মৃত্যুর চেহারাটা দেখতে হবে মহাত্মা গান্ধীর মত।
মৃত্যু বলবেন, “তাড়াতাড়ি চলুন, হাতে অনেক কাজ বাকি। এ ব্লকের আরেকজনের ক্যান্সার হয়েছে, আর রাস্তার ওপাশে এক বুড়ির বয়স হলো সাতানব্বই। তারপর যেতে হবে হাসপাতালে, দেড়বছরের একটা বাচ্চা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। এখন আশেপাশে সাংবাদিক-ক্যামেরা থাকবে না, খুব ভালো সময়। চলুন চলুন, দেরী করে লাভ নেই।“
“আর একটু দাঁড়ান।“
বিছানায় ঝর্ণা আমার পাশে শুয়ে আছে। আমি বলবো, “আপনি তো মৃত্যু, সবকিছুই জানেন। বলুন তো, এ মেয়েটা কি জীবনে সুখী হতে পারবে?”
“তা জেনে আপনি কী করবেন?”
“কৌতূহল, বলুন না।“
“কেমন করে সুখী হবে? ঘুম থেকে ওঠে যখন টের পাবে সারারাত একটা মৃতদেহের ওপর কাটিয়েছে তখন সারাজীবনে এ স্মৃতি ভুলতে পারবে আপনার ধারনা? যখনই চোখ বুজবে তখনই মৃতদেহের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠবে। এ মেয়ের কপালে দুঃখ আছে।“
“আহারে, বেচারি।“
“বেচারির কী দেখলেন? ঐ যে বাচ্চাটার কথা বললাম, তার মা তো পাশেই শুয়ে আছে। বেচারি কাকে বলে তাকে দেখলে বুঝবেন। চলুন, যাওয়ার আগে একবার আপনাকে সেখানেও ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো না হয়।“
কল্পনা এখানেই থেমে যায়। যদি মৃত্যুর পর সে মৃত্যুতে কেউ কষ্ট পায় তবে কি তাকে সার্থক-মরণ বলা চলে? হয়তো। আমি তাই চলে যাওয়াটাকে সার্থক করার চেষ্টা করছি। প্রতিদিনের বিচ্ছিন্নতার মাঝে বেঁচে আছি এ কারণেই, কোন একজনকে দুঃখ দেয়ার জন্য।
বাইরে কাক ডাকছে। এই কুৎসিত-কদাচার প্রাণীটিও কি আমার তৈরি। এই কর্কশ গলা কি আমারই দেয়া। আমিই কি সৃষ্টিকর্তা? সকল অন্ধকার কার মাঝে ভর করে কোথায় গিয়ে ঠায় পায়, কে জানে।
Painting used In the cover is "Self-Seer II (Death and Man)" by Egon Schiele