তারা কেন তবে



আমাদের পরিচয়টা স্বাভাবিক নয়।

সেদিন ক্যান্টিনে বসতে এসেছিলাম। ভয়ানক ভিড়, কোন টেবিল খালি নেই। অন্য সময় হলে ফিরে যেতাম, কিন্তু সারাদিন দৌড়ের উপর থেকে খিদে পেয়ে গেছে। একটা ছেলে কোণার এক টেবিলে বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছিল, সেই টেবিল ছাড়া অন্যগুলোতে দুইজনের কম মানুষ নেই। আমি গিয়ে তার সামনেই বসে গেলাম।

ক্যান্টিনে বেশ কয়েকজন বাচ্চা ছেলে কাজ করে, হঠাৎ তাদের একজন আমার হাতে এসে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। আমি খুলে দেখলাম ভেতরে লেখা আছে, 'মেয়ে, তুমি আমার বন্ধু হবে?'

আমি অবাক হলাম, এ ধরনের কিছু লিখে কেউ যে কেউ আমাকে চিঠি পাঠাতে পারে সেটা কখনও কল্পনাও করিনি, "কে দিল এই চিঠি?"

বাচ্চাটা দেখিয়ে দিল কে দিয়েছে। নীল শার্ট পরা এক ছেলে, বেশ মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। কবিতা কিংবা গল্পের বই হবে। আমি আগে কখনও দেখিনি ওকে। আমাকে কেমন করে চিনেছে সেটাও রহস্য।

অন্যদিন হলে কী করতাম আমি জানি না, কিন্তু আমার স্বভাবের বিপরীত কাজটি সেদিন করে না ফেললে এ গল্পই সম্ভবত বলা হতো না। আমার ইচ্ছে হল, একটু মজা করা যাক। আমি সাথে সাথে কলম বের করে কাগজে উত্তর লিখে দিলাম।

আমার সামনে বসা ছেলেটার ভদ্রতাবোধ মনে হয় একটু কম, কারণ আমি আড়চোখে দেখতে পেলাম খুব মনোযোগ দিয়ে সে আমি কী লিখছি তা লক্ষ্য করছে। আমি বকুনি দেয়া উচিৎ কি না সে সিদ্ধান্তহীনতায় যখন ভুগছি তখন ছেলেটা নিজেই বলে উঠলো, "ভালো ডলা দিলেন ভাই।"

"হু? কী বললেন?"

"বললাম ভাল একটা ডলা দিলেন। লোকটা বেশ নাটকীয় একটা চিঠি পাঠাল, বেচারা একেবারেই বুঝতে পারে নি আপনি একটা ছেলে।" এই কথা বলেই সে ফিকফিক বের করে হাসতে লাগল।

এবার আমি বুঝতে পারলাম কী হয়েছে। আমি শার্ট এবং জিন্স পরে আছি, মাথায় টুপি। দেখে যে কারও ভুল হতে পারে। নীল শার্ট পরা ছেলেটা পড়লেই দেখবে চিঠির উত্তরে লেখা আছে 'আমি মেয়ে না, ছেলে'। কিন্তু তার চেয়েও বড় মজার বিষয় হচ্ছে আমার সামনে বসা ছেলেটাই ধোঁকা খেয়ে গেছে। মাথায় গেঁথে গেছে আমি ছেলে, তাই গলার স্বর শুনেও এখনও কিছু বুঝতে পারে নি। আজকাল এ ধরনের বেকুবের দেখা সহজে মেলে না।

আমি বললাম, "আপনার চোখ কিংবা কানে কি সমস্যা আছে? ওই ব্যাটা দূর থেকে দেখে ভালো করে বুঝবে না, ভাববে আমি সত্যিই ছেলে। কিন্তু তাই বলে আপনারও কী দেখে মনে হচ্ছে আমি মেয়ে নই?"

সে দুই সেকেন্ড হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর যে অপমানটুকু করলাম তা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে একেবারে হো হো করে হাসতে লাগল, "আপনি খুবই ভয়ানক। খুবই ভয়ানক। আমি জীবনে এত মজার ঘটনা দেখিনি।" সে হাসি থামতে আরও দেড় মিনিটের মত লাগল, আর যখন থামল তখন ছেলেটি নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "আমি পল্টু।"

আমি ভদ্রতা করে উত্তর দিলাম, "অতসী।"

যে বন্ধুত্বের ডাক দিয়েছিলো সে তো হতাশ হয়ে ফিরে গেল, কিন্তু আরেকজনের সাথে আমার পরিচয় হল সেদিন। পল্টু একরকম জোর করে ওইদিন আমার খাবারের বিল দিয়ে দিল। আমি ভাবলাম এরপর হয়তো ফেসবুক আই.ডি. কিংবা মোবাইল নাম্বার চেয়ে বসবে, কিন্তু এসব কিছু না করে সে চুপচাপ ক্যান্টিন থেকে চলে গেল।

পল্টুর সাথে আবার আমার দেখা এই ঘটনার ঠিক দুই সপ্তাহ পর। সেদিনও আমি ক্যান্টিনে একা এসেছিলাম। ওদিনের মত ভীর অবশ্য ছিল না, আমি পিছনের দিকে আমার প্রিয় জায়গাটিই খালি পেয়ে গেলাম। অর্ডার নিতে আসার জন্য বসে আছি, তখন দেখি দরজা দিয়ে পল্টু ঢুকছে। ছেলেটা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সবগুলো টেবিলে কাওকে খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকিয়ে হঠাৎ আমাকে দেখেই এত খুশি হয়ে গেল যেন লটারিতে লাখ টাকা পেয়ে গেছে। এগিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারটায় ঝপ করে বসে পড়ে বলল, "আপনার দেখা পাওয়া গেল তাহলে। বের করে ফেলেছি!"

সেদিন টের পেয়েছি কাণ্ডজ্ঞান ছেলেটির মাঝে একটু কম, আর কতটুকু কম এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারনা তার নেই। কথা নেই বার্তা নেই আপনার সামনে এসে যদি কেউ আচমকা 'বের করে ফেলেছি' বলে বসে তাহলে অবস্থা কী হবে কল্পনা করুন, আমার অবস্থা তার চেয়ে খুব একটা ব্যতিক্রম কিছু হয় নি। আমি ঠোঁট কুচকে বললাম, "কী বের করে ফেলেছেন?"

"ওই যে লোকটা আপনাকে চিঠি দিল? তার সব খবরাখবর বের করে ফেলেছি। গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাটাকে ফলো করে বেড়াচ্ছি। ক্যান্টিনে এসেছে পাঁচ থেকে ছ'বার, এর মাঝেই আরও এক-দুজনকে চিঠি পাঠিয়েছে। বড় রকমের লুচ্চা লোক। ব্যাটার ফেসবুক আই.ডি.ও খুঁজে বের করে ফেলেছি। আপনার ঘটনাটা বেশ রঙিয়ে-ঢঙিয়ে লিখে পোস্ট দিয়েছে ওইদিন। এমনকি কয়েকটা পেইজ থেকে ওই লেখা শেয়ারও করেছে, দেখেছেন নাকি?"

এরকম তুচ্ছ কারণে একজন যে অন্য কাউকে ফলো করে বেড়াতে পারে এবং খুঁজে খুঁজে তার ফেসবুক আই.ডি. বের করে ফেলে সেটাই তো রীতিমত অবিশ্বাস্য ঘটনা। পুরো জিনিসটাকে মাথায় সাজাতে আমার ভালই সময় লাগছিল, তাই মুখ দিয়ে যে শব্দটা বের করতে পারলাম তা কেবল, "না।"

"দেখেননি? ভাল করেছেন। ফালতু লেখা। তবে একটা লাভ হয়েছে ওর, পপুলারিটি বেড়ে গেছে মনে হয়। চার-পাঁচ দিন আগে ঠিক ওইদিনের মতই একটা মেয়েকে ছেলেটা চিঠি পাঠাল, আমি পিছন থেকে উঁকি মেরে দেখেছি সেইম প্রশ্ন করেছে। তবে সেই মেয়েটা আপনার মত ডলা দেয়নি, উত্তর পাঠিয়েছে 'বন্ধু হতে চাইলেই হয়, প্রশ্ন করতে হয় না'। সেদিন থেকে কাউকেই আর আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না, কালকে দেখলাম দু'জন একসাথে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আজ নিশ্চয়ই একসাথে রেস্টুরেন্টে খেতে-টেতে গেছে।"

আমি রোবটের মত বললাম, "ও।" সব কিছু আমার মস্তিষ্ক তখনও বুঝে উঠতে পারেনি কি না।

পল্টুর কথা তখনও শেষ হয়নি, "আপনাকে খুঁজছি আসলে কয়েকদিন ধরে। ওইদিন যা একটা কাজ করলেন না, বাপরে! আমি রীতিমতো আপনার ফ্যান হয়ে গেছি। ব্যাটার ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখটা মনে পড়ে আমার এখনও কী রকমের হাসি পাচ্ছে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। আজকেই দেখুন, স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন, তখন কেন যেন আমার ওইদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। আমার তো সাথে সাথে হি হি করে হেসে উঠলাম। তখন তাকিয়ে দেখি স্যার অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। স্যারের মুখ দেখে জানেন, আমার আরও হাসি পেল।" এই বলে পল্টু সত্যি সত্যি মুখ চেপে হাসতে লাগলো।

এভাবেই পল্টুর সাথে আমার পরিচয়টুকু আর একটু বাড়ল।

প্রথমে ওর নাম শুনে আমি ভেবেছিলাম হয়তো গ্রাম থেকে এসেছে। কিন্তু পরে জানতে পারলাম পল্টু পাকা শহুরে ছেলে। ওর এই নামের পিছনে একটা কারণ আছে, সেটা জিজ্ঞেস করতেই লজ্জা পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো, "ওই ব্যাটার আচার আচরণ বুঝলেন, হাইলি সাসপিশাস!"

"জটায়ুর ডায়লগ তো ভালোই ঝাড়ছেন।"

"ডায়লগ ঝাড়ছি কি? সত্যিকার অর্থেই ওর আচরণ সন্দেহজনক। ওইদিন কী হল একবার চিন্তা করে দেখুন।"

ঐদিন যা ঘটেছে সেটা অস্বাভাবিক বলা চলে, কিন্তু সন্দেহজনক বলা যাবে কী? একগাদা সন্দেহবাতিক মানুষের সাথে আমার বসবাস, এই একটা বিষয় আমার ভালোই বুঝার কথা, "চিন্তা করে তো সন্দেহজনক কিছু মাথায় আসছে না আমার। যা বললেন, ছেলেটা হয়তো একটু মেয়েঘেষা। তাছাড়া একজন মানুষ আর একজনের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে, তার প্রক্রিয়াটা নতুন হলেও দোষের তো নয়।"

পল্টু একটা একপেশে হাসি দিলো। পরে আমাকে বলেছে তখন সে চেহারায় একটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব আনার চেষ্টা করছিল। ওর সেই চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। পল্টুর বাচ্চা বাচ্চা চেহারা দেখে আর যাই হোক গোয়েন্দা মনে হওয়ার কোন কারণ ছিল না, "উহু, আসলেও সন্দেহজনক। দেখুন, ঐদিন ক্যান্টিনে অসংখ্য মানুষ ছিল, ঠিক কি না বলুন? এখন ধরা যাক একটা ছেলে কোন মেয়েকে প্রেমপত্র লিখতে চায়..."

আমি ঠিক সেই মূহুর্তে কথায় বাধা দিলাম, "ঠিক প্রেমপত্র তো লিখেনি, লিখেছে বন্ধু হতে চায়।"

পল্টু আমার কথা হাত নেড়ে একেবারে যেন উড়িয়েই দিলো, "ওই হল, বন্ধুপত্র-প্রেমপত্র। যা হোক, ধরা যাক একটা ছেলে কোন মেয়েকে চিঠি লিখতে চায়। তাহলে সে কাকে লিখবে? যদি এমন হতো সে আপনার প্রতি আগ্রহী তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু এই দু সপ্তাহেই সে আরও দুজনকে চিঠি লিখে ফেলেছে। তাহলে বুঝুন, বিশেষ কোন টার্গেট তার নাই। এবার সে কাকে চিঠি লিখবে?"

আমার মাথায় একটা উত্তর চলে এসেছে এর মাঝে, কিন্তু মনের কথা মুখে না এনে জিজ্ঞেস করলাম, "কাকে?"

"যে সবচেয়ে সুন্দরী অবশ্যই তাকে! ওইদিন ক্যান্টিনে যারা ছিল তাদের অনেকেই দেখতে আপনার থেকে সুন্দর ছিল। ওদের রেখে সে আপনাকে কেন চিঠি পাঠাবে?"

আমি জানি আমি দেখতে তেমন ভালো নই। কিন্তু একেবারে অপরিচিত একজন যে আমার মুখের সামনে এই কথা বলে বসবে সেটা আমি আশা করিনি। নিজের রূপ নিয়ে আমার কোনকালেই ব্যস্ততা ছিল না। কিন্তু যে মানুষ পঙ্গু হয়েও ভাল আছে তাকে যদি চোখে আঙুল দিয়ে কেউ দেখাতে যায় যে সে খোঁড়া তবে একেবারেই কি খারাপ লাগবে না?

পল্টুকে আমার বেশ মজার একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ, এবার খুবই বিরক্ত লাগতে লাগল। ছেলেটার কি সামান্য ভদ্রতাজ্ঞানও নেই? মুখ কালো করে বললাম, "আপনি এক কাজ করুন, সবাইকে ফলো করে দেখুন কেন তাদের চিঠি পাঠায়নি। আমার কাজ আছে একটা, এবার উঠতে হয়। আসি।"

পল্টুর চেহারা দেখে মনে হল বেশ হতাশ হয়েছে। মনে হয় আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলার সুযোগটা পেলো না, "তাই? ঠিক আছে। যান তাহলে। পরে কথা হবে আপনার সাথে।"

আমি মনে মনে বললাম, "না, কথা হবে না।"

এই ঘটনার পর ভার্সিটির ক্লাস-ল্যাব নিয়ে আমি ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটাছুটি, দম ফেলবার সুযোগ নেই। পরিশ্রম করতে করতে এমন অবস্থা হল যে  অসুখ বাঁধিয়ে বসলাম। সারাদিন শুয়ে থাকি, জোর করে ঠিভির দিকে তাকিয়ে ছাড়া আর কোন কাজ পাই না। বেশ কিছুদিন ভুগে অবশেষে বিছানা থেকে ছুটি মিলল।

পল্টু নামের সেই ছেলেটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম একরকম। ওর সাথে আর কখনও দেখা হবে না ধারনা ছিল, কিংবা দেখা হলেও এড়িয়ে যাব সেই চিন্তা করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা যা ভাবি সবসময় কি তা হয়? একদিন দুপুরবেলা রাস্তার পাশে দাড়িয়ে রিকশা খুঁজছি, এমন সময় কে যেন পিছন থেকে ডাকতে শুরু করল, "এই যে, অতসী। এই যে।"

আমি পিছন ফিরে দেখলাম পল্টু। উদভ্রান্তের মত চেহারা, ঘেমে একাকার। কাছে আসার পর দেখতে পেলাম টি-শার্টে দুয়েকটা ফুটো তৈরি হয়েছে। আমাকে দেখে মনে হচ্ছে অসম্ভব খুশি। আমি ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলাম, "ভাল আছেন?"

পল্টু টেনেটুনে কুঁচকানো টিশার্টটা সোজা করতে লাগল, "হ্যাঁ, আপনি ভাল আছেন? এতদিন কোথায় ছিলেন? অনেক খুঁজেছি আপনাকে, পাইনি। প্রতিদিন ওই ক্যান্টিনটাতে গিয়ে বসে থাকি, ভাবলাম একদিন না একদিন আপনাকে পেয়েই যাব। কিন্তু আপনি সেই যে গুম হয়েছেন আর খবর নেই। কালকে মনে হল আপনাকে দেখলাম রাস্তার ওধারে, দৌড়ে দেখা করতে গিয়ে রিকশায় লেগে আমার গেঞ্জিটাই ছিঁড়ে গেল।"

আমার সন্দেহ হচ্ছিল পল্টু আমার পিছনেও ঘুরঘুর করা শুরু করেছে হয়ত। কোনভাবে এই আপদ বিদেয় করতে হবে। ভাবলাম এক লাইনে কথা শেষ করে দেই, "আমার কিছু হয়নি। কয়েকদিন এদিকে আসিনি। আজকেও আসতাম না, বাসায় কাজ আছে অনেক। সেখানেই যাচ্ছি।"

আমার কথা শুনে পল্টু ওইদিনের মতই কিছুটা চুপসে গেল। মনে হচ্ছে অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু বলার সুযোগ দিচ্ছি না। সত্যি কথা বলতে বারবার বেচারার হতাশা দেখে আমারও একটু মায়া লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু বিপদ দূর করার জন্য কী ই বা করার আছে আমার, "বাসায় চলে যাচ্ছেন? তাহলে তো আজকেও হবে না....ভালো কথা, আপনার বাড়ির কেউ কি পুলিশে চাকরি করেন?"

প্রশ্নটা শুনে আমি থমকে গেলাম। প্রশ্নটা আকস্মিক এই জন্য নয়, থমকে গেলাম কারণ কেউ এভাবে প্রশ্ন করে যখন সে উত্তর জানে। পল্টুর আমাকে ভালো করে চেনার কোন কারণ নেই, তাহলে ও কেমন করে জানে আমাদের এলাকার থানা আমার বাবার আন্ডারে? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, "কেন বলুন তো?"

"আগে বলুন না কেউ পুলিশের লোক কি না।"

"হ্যাঁ, আমার বাবা। কিন্তু আপনি কেমন করে সেটা জানলেন?"

পল্টু আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। যেটা বলল সেটাও মনে হয় না আমার জন্য, যেন নিজেকেই বলছে, "তাইতো হওয়ার কথা ছিল, অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কেন হবে? এক, দুই, তিন, তারমানে চার।"

ছেলেটা আনমনে বিড়বিড় করেই চলেছে, মনে হচ্ছে প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্য ভান করছে। অন্যদিন হলে চেপে ধরতাম ঠিক, কিন্তু সেদিন আমি বড় ক্লান্ত। ক্যান্টিনের ঘটনায় যতটা বিরক্ত হয়েছিলাম তার থেকেও বেশি বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। কেমন করে বাবার ব্যাপারে পল্টু জেনেছে সেটা রিকশায় বসে মোটামুটি অনুমান করা গেল। যে ছেলে কোন কারণ ছাড়াই দুই সপ্তাহ একজনকে ফলো করতে পারে সে আমার খোঁজখবর বের করে ফেলবে তা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ওর মতলব আছে কোন নাকি কেবল খামখেয়াল?

আমাদের ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার নিচেই থাকেন। বাড়ি এসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেউ আমার খোঁজ করেছে কি না এই কয়দিন, কিন্তু তার কিছু মনে পড়ল না। পল্টুর কথাও আমি আর কাউকে বললাম না। খুব সহজেই ওকে কাটাতে পারতাম, কিন্তু ছোটকাল থেকে নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করে এসেছি। এখন কারও কাছে সাহায্য চাইতে গেলে মনে হয় নিজেকে নিজেই অপমান করছি।

আগেরবারের মত পল্টুর কথা আমি ভুলে গেলাম না কিন্তু।

কিছু কিছু মানুষের চেহারা একবার দেখলেই মনে গেঁথে যায়। পল্টুও তেমন। বয়স নিশ্চয়ই আমার সমান হবে, কিন্তু বাচ্চা বাচ্চা একটা ভাব চেহারার মাঝে আছে। চুল ছোট করে কাঁটা, দাঁড়িও নিয়মিতই ফেলা হয় নিশ্চয়ই। টি-শার্ট ছাড়া আর কিছু পড়তে দেখিনি। একটাতে কোন একটা ফুটবল ক্লাবের লোগো ছিল, নামটা যতদূর মনে পড়ে লিভারপুল। আমি অনুমান করেছিলাম পল্টুর ফুটবল প্রীতি আছো, কিন্তু আরও পরে প্রশ্ন করে টের পেয়েছিলাম পল্টু জীবনে এই ক্লাবের নামও শুনেনি।

যে তথ্যগুলো আছে সেগুলো দিয়ে একজন মানুষকে খুঁজে বের করতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু ক্যান্টিনে যার নিয়মিত যাতায়াত তাকে সেখানকার কেউই চিনবে না এমন নিশ্চয়ই হতে পারে না। দুইদিনে আমি বের করে ফেললাম যে পল্টু আমাদের ভার্সিটিতেই ম্যাথম্যাটিকস ডিপার্টমেন্টে পড়ে। আমার কলেজের বান্ধবী টুম্পাও সেখানে, ওকে জিজ্ঞেস করতেই চিনে ফেলল, "পল্টু? পল্টুর সাথে তোমার কোথায় দেখা হল?"

টুম্পার সাথে আমার কোনকালেই খুব বেশি খাতির ছিল না, বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করার সময়ও আমার হাতে নেই। তাই ওর প্রশ্নটাকে টপকে দিয়ে বললাম, "হয়েছে। তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। আমার পল্টুর বিষয়ে কিছু জানা দরকার, তুমি বরং সেগুলো একটু বল আমায়।"

ছেলেটা টুম্পার মতে সুবিধের নয়। ওর আচরণ অদ্ভুত। ক্লাসের কারও সাথেই পল্টুর খুব একটা সদ্ভাব নেই কিন্তু যে কারও বিষয়ে নাক গলাতে ওস্তাদ। কেউ ওকে খুবই পছন্দ করে এ কথা পল্টু ভাবে কি না তা বলা যায় না কিন্তু ভাবলেও তার সত্যতা অল্পই। কখনও কখনও ও বসে নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে থাকে। প্রথম প্রথম পল্টুকে কারও খারাপ লাগেনি কিন্তু আস্তে আস্তে সবার মনে এই ধারনা শক্ত হয়েছে যে ছেলেটা যতটা না কাজের তার চেয়ে ভাব ধরে তিনগুণ। সবার ধারনা পল্টু নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান ভাবে তার অর্ধেকও সে নয়। তবে বিরক্তিকর হলেও ছেলেটা একেবারেই নিরীহ, সে মানুষের সাতে-পাঁচে থাকার চেষ্টা করলেও কোনদিন কিছু নিয়ে নয়-ছয় করার চেষ্টা করেনি।

টুম্পা এর বেশি কিছু বলতে পারল না, "আসলে হচ্ছে কি অতসী, পল্টুর ব্যাপারে আমরা কেউই তেমন কিছু জানি না। ও থাকে কোথায়, সারাদিন কী করে তাও বলতে পারি না। তোমাকে তো বলেইছি আমরা যেচে কেউ ওর সাথে কথা বলতে যাই না। মাঝে মাঝে ও নিজেই আসে কথা বলতে, কিন্তু আমাদের কারোরই ওর সাথে কথা বলার খুবই একটা আগ্রহ নেই। পল্টু অধিকাংশ সময়ই একা বসে বসে বিড়বিড় করে।"

টুম্পাকে ধন্যবাদ যদিও দিয়ে এলাম কিন্তু ফেরার সময় মাথায় রয়ে গেল একরাশ ক্ষোভ। পুরো ক্লাসের সবাই একজনকে একঘরে করে রেখেছে এটাই আমি মানতে পারলাম না। টুম্পার কথাগুলো শুনে পল্টুর বিষয়ে আমার ধারনা পরিষ্কার হওয়া দূরে থাক, আরও ঘোলাটে হয়ে গেল। একবার মনে হল বাবাকে বলে দেই, ধরে কয়েকটা ঝাড়ি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি পল্টুকে খারাপ ভাবতে পারছিলাম না। ওর উপর বিরক্তিটা রয়েই গেল, কিন্তু তবু কেমন যেন মায়াও হতে লাগল। বেচারার বন্ধুবান্ধব নেই, একাকীত্ব থেকে বাঁচার জন্য আমরা তো কত উদ্ভট কাজই করি।

এক নির্বান্ধব অনুসন্ধানীর শান্তি নষ্ট না করার সিদ্ধান্তটা নিয়ে আমি যে কত বড় কাজ করে ফেলেছিলাম তা সেদিন বুঝতে পারিনি।

কয়েকদিন পর ক্লাস শেষ করে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েছি, এমন সময় পল্টু আমার সামনে এসে হাজির। ছেলেটাকে দেখে আমার ভয় লাগতে শুরু করল, এ অবস্থায় কখনও ওকে দেখিনি। সারা শরীর ঘামছে। মুখের অনুভূতি লুকোনোর কোন চেষ্টাই করেনি, দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কোন বিষয়ে রীতিমত আতঙ্কিত।

পল্টু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল, "জানেন, আজকে আপনাকে না পেলে কী যে হত। ওইদিন আপনার হাতে বই দেখে অনুমান করেছি আপনি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের হতে পারেন। ভাগ্যিস অনুমানটা ঠিক ছিল।" আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনার এ কী অবস্থা?" আমার কথা কানে গেল বলে মনে হল না, পল্টু বলতেই থাকল, "আজ ক্লাস ছিল, সবকিছু রেখে সেই সকাল থেকে এখানে দাড়িয়ে আছি আপনার জন্য। ভাল করে খেয়েও আসিনি। ভেবেছিলাম আরও আগে দেখা হবে, কিন্তু বিকেল হয়ে গেল। কিন্তু আর কার কাছে যাব সেটাই তো মাথায় আসছিল না। আপনার কথা ভাবলাম, আপনি সাহসী মানুষ। তাই দাড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। সময় আছে কি না কে জানে..."

আমি হাত তুলে থামিয়ে দিলাম। এখান দিয়ে মানুষ আসা-যাওয়া করছে, দাড়িয়ে কথা বলা মুশকিল। পল্টুকে নিয়ে আমি একটু কোনার দিকে সরে এলাম, "আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে সেটা আগে বলুন।"

পল্টু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, মনে হয় মাথার ভেতর ঠিক করে নিলো কী বলবে, "একটা ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আমি সেটা জেনে ফেলেছি। শুধু আমিই জানি সম্ভবত, আর কেউ জানে না। সেই ঘটনাটা থামাতেই হবে, কিন্তু আমার এত সাহস নেই। তবে আপনার আছে, আমি প্রথমদিনই টের পেয়েছি। তাই আপনাকে খুঁজে বের করেছি। আপনি প্লিজ চলুন আমার সাথে।"

আমি বললাম, "কীসের ভয়ানক ঘটনা? আপনি দয়া করে স্পষ্ট করে বলবেন সমস্যাটা কোথায়?"

পল্টু বলল, "যেতে যেতে বলব। সময় নেই। এখনই হয়ত ভয়ানক দেরি হয়ে গেছে। প্লিজ চলুন আপনি আমার সাথে। আপনি ঠেকাতে পারবেন, আমি নিশ্চিত আপনি পারবেন। প্লিজ।"

কিছুতেই প্রায় অপরিচিত উদ্ভট একটা ছেলের সাথে আমি কোথাও যেতাম না, যতই তার উপর মায়া লাগুক। কিন্তু নিজের উপর অন্যের বিশ্বাস ভেঙে ফেলা খুব কঠিন কাজ। পল্টুর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে আমি সাহসী এবং আমি তার সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি। হঠাৎ আমার নিজের উপর আস্থাটাও বেড়ে গেল। পল্টুর সাথে যেতে তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম। হাতে সময় নেই, অন্য কিছু না দেখে পল্টু একটা সিএনজি ভাড়া করে ফেলল।

সিএনজি যাচ্ছে, পল্টু মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে চিন্তা করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "এখন বলবেন কী হয়েছে?"

পল্টু আমার দিকে তাকাল, যেন কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না, "ওইদিনের ছেলেটার কথা মনে আছে আপনার? ওই যে ক্যান্টিনে আপনাকে চিঠি পাঠিয়েছিল?" আমি মাথা নাড়লাম, সে ঘটনা আমার স্পষ্টই মনে আছে।

পল্টু বলতে লাগল, "আমি আপনাকে সেদিনই বলেছিলাম ওর আচরণ সন্দেহজনক। মানুষের আচরণের দুইটা লিমিট আছে। কেউ যখন লিমিটের বাইরে চলে যায়, তখন সন্দেহ লাগে। মানুষ যখন অযৌক্তিক কাজ করে তখন একটা ঘাপলা থাকে। আপনাকে বলেছি আমি ওর বিষয়ে খোঁজখবর করেছি, পিছনে লেগে রয়েছি। আপনাকে এটাও বলেছি যে আপনার সাথে সে যে কাজ করেছিল তা আরও করেছে, নানাভাবে মেয়েদের সাথে খাতির জমাতে চেয়েছে। আমি ওর কাজে প্যাটার্ন খুঁজেছি। কেন এই মেয়েরাই? কেন অন্য কেউ নয়?"

আমি  জিজ্ঞেস করলাম, "প্যাটার্ন পেলেন?"

"ওইদিন আমি আপনাকে কী জিজ্ঞেস করেছিলাম মনে আছে? আপনার পরিবারের কেউ পুলিশে চাকরি করে কি না? আপনি বললেন আপনার বাবা।"

"হ্যাঁ, তাও মনে আছে।"

পল্টু হাসল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওর চেহারা থেকে কিছুক্ষণ আগেই যে ভয় ছিল তা দূর হয়ে গেছে। কেমন করে যেন বাচ্চাবাচ্চা ভাবটাও অনেকটা চলে গেছে। ওর চোখ চকমক করছিল, তেমন দৃষ্টি আমি কোথায় যেন দেখেছি কিন্তু মনে করতে পারছি না।

আর মনে করার সুযোগই বা পেলাম কোথায়, পল্টু যে তখনই সিএনজিতে বোম ফাটাল, "ওই ছেলেটা, ফারহাদ ওয়ালি, যতজন মেয়ের সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করেছে তাদের সকলের বাবাই পুলিশের লোক।"

আমি ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

সিএনজিটা এক গলির সামনে এসে থামল। পল্টুর ওই ছেলে, অর্থাৎ ফারহাদ ওয়ালির বাড়ি খুঁজে বের করতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। অন্য সময় হলে আমি হয়ত অবাক হতাম এতে, কিন্তু পল্টুর কাজকর্ম এখন আমি একটু একটু বুঝতে পারছি। তাছাড়া, অবাক হওয়ার অবকাশ আমার ছিল কই? একজন লোক কেন খুঁজে খুঁজে পুলিশের মেয়েদের সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করবে সেই প্রশ্নের উত্তর বের করতেই তো আমার মস্তিষ্কের সকল শক্তি ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল।

অসংখ্য উত্তর আমার মাথায় আসতে শুরু করেছে। ছোটবেলায় শার্লক হোমস কিংবা ফেলুদার বইগুলো গিলেছি, আমার বাবাকে কতবার কল্পনা করেছি তিন গোয়েন্দার ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের সাথে। ফারহাদ ছেলেটার কি পুলিশের উপর কোন রাগ আছে? পুলিশের মেয়েদের আঘাত করে প্রতিশোধ নিতে চায়? তাই যদি হয় তাহলে সে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ।

পাগলরা খুব ভয়ানক হয়। অস্বীকার করব না, প্রথমে আমারও সামান্য ভয় লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ যখন মনে পড়ল ওই ছেলেটার কারণে অন্য একজনের বিপদ হতে পারে তখন ভয়টার কথা আর মনে রইল না।

বাসার দরজা খুলে দিল কাজের মেয়ে, "কারে খুঁজেন?"

পল্টুর মুখের উপর আমার বিশ্বাস কম। মাঝে মাঝে ও যে না বুঝে কথা বলে ফেলে তার প্রমাণ এর মাঝে কয়েকবারই পেয়েছি। তাই আমিই জিজ্ঞেস করলাম, "এটা ফারহাদ ভাইয়ের বাসা তো? উনি কি আছেন?"

কাজের মেয়ে মাথা নাড়ল, "উহু। ভাইজান তো বাহিরে গেছেন।"

আমি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম কোথায় গেছে জানে কি না, কিন্তু পল্টু আর অপেক্ষা না করেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। আমি থামার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পল্টু আমার দিকে তাকিয়ে একবার কেবল বলল, "চলুন।" আমি বুঝতে পারলাম কোথায় যেতে হবে তা এই মেয়ের চেয়ে পল্টুই ভাল জানে।

এবার রিকশায় উঠতে হল। রিকশাওয়ালা ভয়ঙ্কর উঁচু একটা ভাড়া চেয়ে বসল, পল্টু বিন্দুমাত্র আপত্তি না করে উঠে বসল। আপত্তি করার সময় যে এটা নয় তা আমি ভালই বুঝতে পারছিলাম।

সিএনজি তে চুপ ছিল কিন্তু পল্টু এবার কথা বলতে শুরু করল, "অতসী, আপনি যদি একই বাড়ির পাঁচ-ছয়জন মানুষকে খুন করতে চান তাহলে কেমন করে করবেন? আপনার হাতে সময় বেশি নেই, এবং বাড়িতে পাঁচ-ছয়জনের সবাই উপস্থিত আছে। তাহলে কেমন করে খুন করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।"

আমার খুব একটা চিন্তা করতে হল না উত্তর দিতে, "গুলি করে।"

"হ্যাঁ, অধিকাংশই সেই চিন্তা করবে। এর থেকে সহজ উপায় নেই। কিন্তু একটা বড় সমস্যা আছে। যদি আমেরিকার মত দেশ হতো, তাহলে সমস্যাটা টের পাওয়া যেত না। কিন্তু এদেশের কথা আলাদা। এখানে ইচ্ছে করলেই রাইফেল যোগাড় করা যায় না। বলুন, খুন যে করবেন আপনি, ফায়ার-আর্মস কোথায় পাবেন?

উত্তরটা দিতে গিয়েও আমি দিলাম না, ঝট করে পল্টুর দিকে তাকালাম। ফারহাদ ওয়ালির আচরণের একটা অংশ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

এখানে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র কোথায় পাওয়া যায় তা আমার জানা নেই। প্রশ্ন করব কাকে তাও জানি না। লাইসেন্স করার সুযোগ নেই। কিন্তু একটা পিস্তল যোগাড় করতে আমার খুব একটা কষ্ট হবে না। আমার বাবা পুলিশের লোক। সাধারণ মানুষেরও জানার কথা একজন পুলিশের কাছে পিস্তল থাকবেই।

প্রথমে আমার মনে হচ্ছিল ফারহাদ ওয়ালির ক্ষোভ পুলিশের উপর। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি আসলে তা নয়, "পল্টু, ফারহাদের চিঠির ফাঁদে শেষপর্যন্ত কেউ একজন ধরা দিয়েছিল, তাই না? ওইদিন আপনি বলেছিলেন। এমন কেউ যার বাবা পুলিশের লোক?"

"হ্যাঁ, দিয়েছিল। লোকটার পটানোর ক্ষমতা আছে স্বীকার করতে হবে। এর মাঝে সে মেয়ের বাসার সাথে পরিচয় করে ফেলেছে, গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ওদের বাসায় কাটিয়েও এসেছে।"

উত্তর কী পাব তা আমি এখন নিশ্চিত, কিন্তু তবু প্রশ্ন করলাম, "আজ কিংবা গতকালের মাঝে কি ওদের বাসা থেকে ওর বাবার সার্ভিস গান চুরি গিয়েছে?"

পল্টু আমার দিকে তাকাল। আমি দেখতে পেলাম ওর মুখে গর্বের হাসি। এই গর্ব নিজের জন্য নয়। যেন গুরু তার শিষ্যের সাফল্য দেখে গর্বিত, ক্লাসে শিক্ষকের প্রিয় ছাত্রী সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে ফেললে তিনি যেভাবে হাসেন এ তেমন হাসি, "আপনি ধরে ফেলেছেন? আমি জানতাম আপনি বুঝতে পারবেন! হ্যাঁ, চুরি হয়েছে। গতকাল। খবরটা বের করতে কষ্টও হয়েছে বেশ। কাজটা যে লোকটা সত্যি সত্যি করে ফেলতে পারবে এমন আশা আমি করিনি। ওকে যতটা অকাজের ভেবেছিলাম ততটা অকাজের ও নয়। একজন পুলিশের বাসা থেকে তারই সার্ভিস রিভলভার চুরি করা সহজ কথা নয়।"

এরপর রিকশা থেকে কোথায় আমরা দৌড়োলাম সে রাস্তা আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে একটা সেলুন দেখেছি রাস্তার মাথায়, আর একটু পরেই ছোট একটা চায়ের দোকান। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল ঠিক সেই সময়টাতেই এলাকায় বিদ্যুৎ চলে গেছে। আমরা ছুটছি এক রহস্যের পিছনে, আর তার সাথে মিল করেই যেন বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি বলে বুঝাতে পারব না, কিন্তু চায়ের দোকানের কুপি, দূরের বাড়িগুলো থেকে আসতে থাকা আবছা আলো, সরু গলি, নির্জনতা আর অপরাধের আশঙ্কা মিলিয়ে যে পরিবেশটা তৈরি হয়েছিল তখন তাতে আমার নিজেকে সত্যিই থ্রিলার ছবির চরিত্র বলে মনে হচ্ছিল।

আমি নিজেই কখনো জানতাম কি যে এই অবস্থায় আমার মনের ভয়-ডর একবিন্দু না বেড়ে সব দূর হয়ে যাবে? আমি ভেবেছিলাম কি আমার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠা চিকন হাসির কথা?

পল্টুর অবস্থা আলাদা। একটু আগেই ঠিক ছিল, অন্ধকারে যা দেখলাম ও এখন ঘামছে। পরে অবশ্য পল্টু আমায় বলেছিল এতটা ঘামার কারণ ছিল একটা, এই অন্ধকার আর নির্জনতাকে আমি যে প্রথমে কাকতালীয় ভেবে বসেছিলাম আসলে মোটেও তা নয়। গত কয়েকদিন ধরে ঠিক ওই সময়টাতেই এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছিল। ফারহাদ ওয়ালি খোঁজখবর করেই এসেছে। অন্ধকারে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কারও বাড়িতে ঢুকে পড়া সহজ।

দৌড়াতে দৌড়াতে কোথা থেকে কোথায় এলাম সে জ্ঞান আমার নেই। পল্টুই হঠাৎ আমাকে হাত ধরে থামিয়ে দিল, "দেখুন অতসী। ওই যে!"

আমি তাকালাম। ফারহাদ অন্ধকারে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত-পা কিছুই নড়ছে না। এত দূর, তার উপর অন্ধকার, তাই হাতে পিস্তল ধরা আছে কি না আমি বুঝতে পারলাম না। পল্টু ভয়ে ভয়ে বলল, "এখন কী করব? এখনও ভেতরে ঢুকেনি। পিছনে গিয়ে কিছু দিয়ে মাথায় বাড়ি-টাড়ি মারব নাকি?"

"পাগল নাকি! মাথায় ঠিকমত আঘাত লাগলে মারা যেতে পারে। আপনি মার্ডার কেসে ফাঁসতে চান?"

"তাহলে?"

আমি আবার ওইদিকে তাকালাম। মূর্তি এখনও জীবন্ত হয়নি। আমি সামনে পা ফেলতে শুরু করলাম, পল্টুও আমার পিছন পিছন আসতে লাগল। আমরা এতটা কাছে চলে এসেছি, তবু লোকটার চেহারায় কোন ভাবান্তর নেই। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। শূন্য দৃষ্টি। নাহ, শূন্য তো নয়। চোখে ভয়। কেবল ভয়।

এত সহজে কেউ খুন করতে পারে কি? আমার ধারনা পারে না, ফারহাদ ওয়ালির মত কাপুরুষেরা তো আরও নয়। আমি দ্বিধা না করে ডেকে উঠলাম, "ফারহাদ।"

ফারহাদ চমকে গেল। না চমকালেই বরং সেটা ভয়ের কারণ ছিল, "কে?"

আমি আরও এক পা এগুলাম, "আমার নাম অতসী। আমার বাবা পুলিশের লোক। ভার্সিটির ক্যান্টিনে আপনি আমাকে চিঠি লিখেছিলেন।"

ফারহাদ সম্ভবত আমাকে চিনতে পারল। আমি দেখলাম ওর হাত কাঁপছে। অনেক কাছে চলে এসেছি, এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ডান হাতে ধরা পিস্তলটা। আমি গলা শক্ত করে বললাম, "আপনার ডান হাতে পিস্তল, আপনি ঠিকমত ধরতেও পারেননি। ওটা মাটিতে রাখুন।"

ফারহাদ তোতলাতে তোতলাতে বলল, "কিন্তু, কিন্তু আমি যে..."

আমি ওকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না, "আপনি পিস্তলটা মাটিতে রাখুন। ওটা খেলনা নয়। এখনই রাখুন। জেলে যেতে চান?"

"কিন্তু হারামজাদা রকিব..."

পল্টু এতক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে ছিল, এবার আমার পিছন থেকে বলে উঠল, "রকিব আপনার ক্লাসমেট। আপনি মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভালোবাসেন, তাদের মুগ্ধ করতে গিয়ে নিজের নামে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলেন, তাই না? কিন্তু তাদের একজন যে রকিবের খালাতো বোন তা আপনি টের পাননি। রকিব সবার সামনে সে ম্যাসেজগুলো পড়ে শুনিয়েছে। আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে ক্লাসে, সবার সামনে আপনাকে অপমানিত হতে হয়েছে। তখন নাহয় রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলেন ওর ফ্যামিলির সবাইকে আপনি দেখে নিবেন। তাই বলে এত সামান্য একটা কারণে আপনি এক বাড়িভর্তি মানুষকে খুন করতে চলে এসেছেন?"

আমি এই কারণটা জানতাম না, এখন জানার পর লোকটাকে আমার মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল না। এত তুচ্ছ একটা কারণ? এত সামান্য কারণ? তখন যা বোধ হচ্ছিল, আমার কল্পনাশক্তি আর একটু ভাল হলে হয়তো দেখতে পেতাম ফারহাদ ওয়ালির জায়গায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির একটি তেলাপোকা দাড়িয়ে আছে। আর বেচারার কি দুর্ভাগ্য, যে মেয়েরা তেলাপোকা কিংবা মাকড়সা দেখে আঁতকে উঠে আমি তাদের দলের নই, "একটা অন্যায় আপনি করে ফেলেছেন পিস্তল চুরি করে। খুনের অপরাধে যে ফাঁসি হবে সেটা বুঝতে পারছেন? এখনও সময় আছে। পিস্তলটা মাটিতে রাখুন। এখনই রাখুন!"

লোকটা কাঁদতে শুরু করল। অসহায় মানুষকে কাঁদতে দেখে আমাদের মায়া-দয়া লাগার কথা। কিন্তু আমার মনে হতে লাগল এত কুৎসিত দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। আমি সামনে পা বাড়ালাম। মাটিতে পিস্তল রাখার মত ক্ষমতাও এই লোকটার এখন আছে বলে মনে হয় না। সেটা আমাকেই ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে।

পল্টু পিছন থেকে আমায় ডাকল, "অতসী! সাবধান।" আমি লোকটার হাতে আলতো করে ধরে রাখা পিস্তলটায় টান মারতেই সেটা আলগা হয়ে গেলো। পল্টুকে শান্ত স্বরে আমি জবাব দিলাম, "কোন ভয় নেই। পুলিশকে খবর দিতে পারবেন?"

◯ ◯ ◯

পল্টু লোকটার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে আর একে ওকে জিজ্ঞেস করে যা জানতে পেরেছিল, ফারহাদ লোকটা কাপুরুষ ও নিচ হওয়ার পাশাপাশি একজন অবসেসিভ মাত্রার নার্সিসিস্ট। যেসকল মানুষ নিজের বাইরের রূপ নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন সে তাদেরই একজন। অপমানিত হওয়া, বিশেষ করে ওর মত একজনের জন্য সহজ কথা নয়। ক্লাসে সবার সামনে চুনকালি নাকি ভালোই লাগানো হয়েছিল ওর মুখে, ঠিক কেমন করে অপমানটা করা হয়েছে পল্টু তাও জিজ্ঞেস করে বের করে ফেলছিল কিন্তু আমি জানার তেমন একটা আগ্রহ পাইনি। ওই ঘটনার পর নাকি এমন অবস্থা হয়েছে যে জুনিয়ররাও লোকটাকে দেখে হাসত। ওর ক্লাসমেট রকিবকে সে রীতিমত হুমকি দিয়েছিল যে ওর ফ্যামিলির সবাইকে দেখে নেবে। সে কথাও কেউ ভালোমতো নেয়নি, ওর উচ্চতাও দিনে দিনে কমতে কমতে মোটামুটি আধফুটে এসে দাঁড়িয়েছিল।

সিনেমায় এধরনের ঘটনা নাকি প্রায়ই ঘটে, তাই ফারহাদ ওয়ালি খুব ভেবেচিন্তে জটিল একটা প্ল্যান করেছিল প্রতিশোধ নেওয়ার। লোকটা পোকামাকড় বলেই প্রতিশোধের ইচ্ছাটা ছিল একশভাগ, কিন্তু পতঙ্গরা তো আর মেরুদণ্ডী প্রাণী নয়। পিস্তলটা যদিও কোনভাবে চুরি করেছে কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আসার পরপরই মাথা উলট-পালট হয়ে গেছে। কারণ পুলিশ আসার পর পিস্তলটি যখন পরীক্ষা করা হল তখন টের পাওয়া গেল তাতে কোন গুলিই ছিল না!

ঘটনাটা নিয়ে কেলেঙ্কারি হবে তা অনুমান করেছিলাম, কিন্তু পিস্তলে গুলি না থাকায় পুলিশের প্রশ্নোত্তর আর চিৎকার-চেঁচামেচি একেবারে কমে গেল। তাছাড়া আমার বাবা এ শহরে মোটামুটি পরিচিত, তার পরিচয় দেওয়ায় কয়েকটা প্রশ্ন করে আর পরে একসময় সাক্ষী হিসেবে থাকতে হতে পারে বলে আমাদের ছেড়ে দেয়া হল। লোকটার কেমন সাঁজা হবে তা আমি বলতে পারি না, সাক্ষী হিসেবে আমাকে আর পল্টুকে ডাকা হলে হয়তো তা জানা যাবে। পুলিশের যে অফিসার ছিলেন তিনি চেয়েছিলেন আমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে, আমিই মানা করে দিলাম।

জীবনে এমন কোন অভিজ্ঞতা আমার হবে তা কল্পনাও করিনি। দায়টা পুরোপুরি পল্টুর। সেজন্যেই বোধহয় আমি রাস্তার পাশে দাড়িয়ে যখন বাড়ি ফেরার উপায় খুঁজছিলাম পল্টু কিছুক্ষণ আমার সাথেই দাড়িয়ে রইল। তারপর একসময় বলল, "আচ্ছা, আমি যাই?"

আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কোথায় যাবেন এখন?"

পল্টু হাসল। ছেলেটার চেহারায় যে বাচ্চা বাচ্চা ভাবটুকু আজ সামান্য সময়ের জন্য দূর হয়ে গিয়েছিল তা আবার ফিরে এসেছে। একটু আগেই ওর চোখের দৃষ্টি দেখে আমার মনে হচ্ছিল সে দৃষ্টি কোথায় যেন দেখেছি, এখন চোখে তার ছিটেফোঁটাও নেই, "আমি সারাদিন কিছু খাই নি, ভয়ানক খিদে লেগেছে। দেখি আশেপাশে কোথাও খাবার পাওয়া যায় নাকি। যাই, কেমন?"

পল্টু হাঁটতে লাগল। রাস্তায় পিছন থেকে ছেলেটাকে দেখতে দেখতে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ওর চোখের সে দৃষ্টি আগে কোথায় দেখেছি। না, আসলে দেখিনি, বলা উচিৎ কল্পনা করেছি। ছেলেবেলায় যখন গোয়েন্দা গল্পগুলো প্রাণভরে পড়তাম তখন মনে মনে হোমস কিংবা প্রদোষ মিত্রের চোখে সেই দৃষ্টিই যে আমি বসিয়ে দিয়েছিলাম তা এখন মনে পড়ছে।

পল্টুর ক্লাসের ছেলেমেয়েদের উপর আমার যে অতি সামান্য একটা রাগ ছিল সেটা মাত্রায় বেড়ে গেল। আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম ওরা পল্টুর ব্যাপারে কিছুই ঠিকমত অনুমান করতে পারে নি। ছেলেটার একঘরে হয়ে থাকতে হচ্ছে ও শুধু অন্যদের মতন নয় বলে। তবে একটা মানুষও কি কখনও ওর উৎপেতে স্বভাবের দেয়াল ডিঙিয়ে অন্য পাশের কচি ঘাসের মাঠ আর কাঁচপানির ছোট নদীটার উপর চোখ ফেলতে পারল না?

পল্টুকে ঠিক ওয়াটসন বলা যায় না। তবে আমিও নিশ্চয়ই শার্লক হোমস নই!

ও অনেকদূর চলে গেছে। কী আর করব, চেঁচানোই ভাগ্যে আছে, "পল্টু, দাঁড়া না ভাই, আমাকেও নিয়ে যা।"

  কভার ছবিটি ডিজিটালি তৈরীকৃত  

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: