মৌমাছিরা কতটা আশ্চর্য হতে পারে (How amazing bees can be)

জুন ০৯, ২০১৩ , 0 Comments


আপনি যদি ইন্টারনেট একটু ঘাটাঘাটি করেন তবে একদল মানুষের দেখা পাবেন যারা নিজেদের Flat Earth Society(চ্যাপ্টা পৃথিবী সংগঠন) বলে দাবী করে। তাদের কথা হচ্ছে আমাদের পৃথিবী আসলে গোল নয় চ্যাপ্টা। সাধারনত অস্ত্র হিসেবে এরা ব্যবহার করে ধর্মগ্রন্থগুলোকে, কিন্তু পৃথিবীকে চ্যাপ্টা বানানোর উদ্দেশ্যে বৈজ্ঞাণিক আর ঐতিহাসিক যুক্তিও কম নেই তাদের।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবী যে গোল এই ধারনাটা মৌমাছিরাই ব্যবহার করে। আমরা জানি প্রাণীজগতের সবচেয়ে জটিল মস্তিষ্কের প্রাণী হচ্ছে মানুষ, সেই হিসেবে মৌমাছি তো তুচ্ছ। তাই বলে ওদের একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এই যেমন, মৌমাছিরা খুব ভাল গণিত জানে। একটা বিখ্যাত সমস্যা আছে, অনেকগুলো রাস্তার মধ্য হতে সবচেয়ে ছোটটা খুঁজে বের করার। দেখা যায় যে মৌমাছিরা

কম্পিউটার থেকে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে ফুল থেকে ফুলে উড়ার জন্য মধুমক্ষিকারা তাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে ঠিকই সেই পথটা খুঁজে বের করে যেটা দিয়ে গেলে সময় আর পরিশ্রম সবচেয়ে কম হবে।
অর্থাৎ বুঝা যাচ্ছে, মৌমাছিরা খুব চমকপ্রদ প্রাণী্। সত্যি বলতে কি, পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক প্রাণীদের একটা
হচ্ছে মৌমাছি। আমরা আগেই বলেছি মৌমাছির মস্তিষ্ক অনেক জটিল কাজ করতে পারে, কিন্তু মানুষের বুদ্ধিমত্তার কাছে কিছুই নয়। ধারনা করা হয় মানুষ ও মৌমাছির বিবর্তনের ধারা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগেই পৃথক হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের সাথে অন্য একটা বিষয়ে মিল আছে ওদের, সামাজিকতা।
মৌমাছি হচ্ছে যাকে বলে সামাজিক পতঙ্গ। যদিও সব মৌমাছির প্রজাতি সম্পূর্ণ সামাজিক নয়, তবে আমরা সাধারণত যেসব মৌমাছি দেখি যারা চাক বানিয়ে বাস করে তারা সম্পূর্ণ সামাজিক। অনেক প্রাণীই দেখা যায় দল বেধে বাস করে, কিন্তু তবুও সামাজিক নয়। আমরা তিনটা বৈশিষ্ট্য থাকলে কোন প্রাণীকে সম্পূর্ণ সামাজিক বা eusocial বলতে পারি – (১) একই জায়গায় একসাথে অনেক জেনারেশনের প্রাণী একত্রে বসবাস করবে, (২) কেউ যে শুধুমাত্র তাদের সন্তানদেরই লালন পালন করবে তা নয়, বরঞ্চ অন্যদের সন্তানদেরও খেয়াল রাখবে এবং (৩) শ্রমবিভাজন থাকবে অর্থাৎ দলের সবাই এক কাজ করবে না, যে যেটা সবচেয়ে ভাল পারে সে তাই করবে। পিঁপড়ে আর বোলতাদের মাঝেও অনেকসময় এই লক্ষণগুলো দেখা যায়।
মৌমাছিদের সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যাপারগুলোর একটা হচ্ছে তাদের জীবনধারা, রাজকীয় ষড়যন্ত্রোপাখ্যানের মত। একবার তাহলে মৌচাকে উঁকি মেরে দেখা যাক। একটা মৌচাকে তিন ধরনের প্রাপ্তবয়ষ্ক মৌমাছি থাকে। অনেক অনেক কর্মী বা workers (সবাই নারী), কিছু পুরুষ বা drones, এবং একজন মাত্র রাণী বা queen।
রাণী মৌমাছিকে বলা যায় মৌচাকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার কারণ এই নয় যে রাণী বলেই তিনি অন্যদের নেতৃত্ব দেন। কারণ রাণীই মৌচাকের একমাত্র মহিলা যার প্রজনন ক্ষমতা আছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে মৌচাকের প্রায় সব মৌমাছির মা একজন রাণী! রাণী যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটা উদাহরন দেওয়া যাক। আমরা বলি যে একজন মানুষের মৃত্যু কখনও সমগ্রজাতির ধ্বংস ডেকে আনতে পারে না। মৌমাছিদের ক্ষেত্রে পারে। যদি ডিম দেওয়ার আগেই রাণী মৌমাছি অক্কা পান অথবা কোন কারণে সময়মত পুরুষের সাথে যৌন মিলন ঘটাতে না পারে, বুঝতে হবে মৌচাক খতম পরবর্তী জেনারেশনেই খতম।
পুরুষ মৌমাছিরা একটু আলসে প্রকৃতির। বিশেষ কাজটাজ কোন করে না। ওদের আকার ছোট, হুল নেই, শুধু আছে বড় বড় চোখ। বড় বড় চোখ দিয়ে রাণীকে তারা সহজে খুঁজে বের করতে পারে। সারাজীবন পুরুষ মৌমাছিরা কাজের কাজ একটাই করে আর তা হল রাণীর সাথে মিলন ঘটানো। উড়ন্ত অবস্থায় রাণীর সাথে পুরুষের যৌন মিলন ঘটে। একদিনেই রাণী মৌচাকের সকল পুরুষের সাথে মিলিত হয় আর প্রায় ৬ মিলিয়ন শুক্রানু গ্রহন করে। পুরুষ মৌমাছির জীবন বেশ আনন্দেরই বলা যেত, কিন্তু বলা যাবে না যেহেতু মিলনের পরপরই তারা মারা যায়!
রাণী ডিম দেওয়া শুরু করে, দিনে প্রায় ২০০০ টা করে। ডিম ফুঁটে লার্ভা বের হয়। কর্মী লার্ভা, পুরুষ লার্ভা আর কিছু হবু রাণী বা রাজকন্যা লার্ভা। রাণী লার্ভাদের কর্মীরা সাধারন খাবার না দিয়ে রয়্যাল জেলি খাওয়ায়, যা তাদের যৌন প্রজননে সক্ষম করে ভিন্ন গঠনে গড়ে তুলে।
যাই হোক, লার্ভা থেকে পিউপা আর তা থেকে একটা রাণী মৌমাছি বের হয়েই দেয় রণহুংকার(আমি উপমা লাগাচ্ছি না, সত্যি সত্যি দেয়)। এই রণহুংকারে মৌচাকের বাকি বাসিন্দারা বুঝতে পারে প্রস্তুত সে যুদ্ধের জন্য, কে কার থেকে বেশি শক্তিশালী আর কার পক্ষ নিতে হবে। শুরু হয় সব নতুন রাণীর যুদ্ধ! একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলে, একজন শেষপর্যন্ত টিকে থাকে!
যদি মৌমাছিদের মৌচাক ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন অবশ্য কর্মীরা রাণীদের যুদ্ধ নিজেরাই থামিয়ে দেয়। দলবেধে সবাই বাড়ি পরিবর্তন করে।
তারপর রাণীরা একজন আরেকজনকে খুন কর ফেলে।
ডিম দেওয়ার পর আমাদের পুরাতন রাণীসাহেবার কোন বিশেষ কাজ থাকে না, বরঞ্চ তিনি বিপদে পড়ে যান। যতদিন রাণী কুমারী থাকে ততদিন রাণীশূন্য অপর কোন মৌচাকে তাদের স্বাগতম জানানো হয়। কিন্তু পুরনো রাণী, যারা ইতিমধ্যেই যৌনমিলন ঘটিয়েছে, তাদের দেখলেই মৌচাকের বাসিন্দারা তেড়ে আসে। নিজের ঘরেও শান্তি নেই। নতুন রাণী নির্বাচনের সাথে কর্মীরা জোট বেধে রাণীকে জাপটে ধরে। এতে রাণীর চারপাশে প্রচণ্ড উত্তাপ সৃষ্টি হয় আর সবাই মিলে পুরাতন রাণীকে এ পদ্ধতিতে মার্ডার করে ফেলে!
মৌচাকের কর্মী বা শ্রমিকেরা যে মোটেও সাদাসিধে নয় বুঝাই যাচ্ছে। সংখ্যায় ওরাই বেশি এবং মৌচাকের যাবতীয় কাজকর্ম তারাই করে। বাসা বানানো থেকে শুরু করে মধু সংগ্রহ পর্যন্ত। তরুণরা থাকে মৌচাকের ভেতর আর অভিজ্ঞরা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। কর্মীদের সবারই আলাদা পদ থাকে(এমনকি মৃত মৌমাছি সরানোর পর্যন্ত)।
মৌমাছিদের জীবনধারা আজব সন্দেহ নেই, কিন্তু তার থেকে অবিশ্বাস্য কাজ করতে পারে ক্ষুদে পতঙ্গগুলো। যেমন – ওরা ছবিতে মানুষের মুখ আলাদা করতে পারে। মৌমাছি যে ভাল মানের গণিতজ্ঞ তা আগেই বলা হয়েছে। আরও ভাল করে বুঝা যায় ওদের মৌচাক দেখলে।
মৌচাক অনেকগুলো ছোট ছোট ষড়ভুজাকার খোপ নিয়ে তৈরি। প্রশ্ন হল, ষড়ভুজ কেন? কেন বৃত্ত নয়, কেন চারকোণা বা তিনকোণা নয়। উত্তরটা সহজ, মৌচাক বানানোর জন্য গাণিতিকভাবে ষড়ভুজের থেকে ভাল আকৃতি আর হতে পারে না। কোন ফাঁকা জায়গা না রেখেই একটা ষড়ভুজের সাথে আরও ছয়টা যু্ক্ত হতে পারে, এবং যথেষ্ট মজবুতও হয়।
মৌমাছির ফ্লাইং প্যাটার্ন হচ্ছে আরেকটা অবাক করা বিষয়। মৌমাছিরা যখন মধুর জন্য ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়, মৌচাক থেকে দূরে সরে যায়, তখন অন্যদের সাথে কেমন করে যোগাযোগ করে? কেমন করে তারা মৌচাকের দূরত্ব আর দিকের হিসেব রাখে আর একে অপরকে খবর পাঠায়? Bee Movie অ্যানিমেশন ছবিটার মত তাদের মাথায় ওয়্যারলেস সেট করা থাকেনা, যে কাজটা করে তারা তা আরও বেশি অবিশ্বাস্য! মৌমাছিরা যে প্যাটার্নে উড়ে বেড়ায়, সেটা মোটেও কোন সাধারণ প্যাটার্ন নয়। একে বলা হয় bee dance। একটা মৌমাছির জটিল ফ্লাইং প্যাটার্ন দেখে অন্যরা বুঝতে পারে খাবার কোথায় আছে, মৌচাক কোনদিকে আছে। এই নাচের প্রক্রিয়া অনেক জটিল, আগ্রহীদের প্রতি আহবান রইল পারলে মৌমাছির নাচ আর ফ্লাইং প্যাটার্ন নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য।
মৌমাছি যে খুব সুন্দর তাতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু তবু্ও আমরা মৌমাছি ভয় পাই কারণ আর কিছু নয়, এর হুল। আমার ধারনা আমাদের মাঝে অনেকের গায়েই মৌমাছি হুল ফুঁটিয়েছে(যেমন : লেখক) এবং সেই স্মৃতি ভূলার মত নয়। মৌমাছি কারণ ছাড়া কারও গায়ে হুল ফুঁটায় না, যদি না কেউ মৌমাছিকে চাপা দিতে চায় নয়তো মৌচাক ধ্বংস করতে যায়। কর্মী মৌমাছিরা আসলে জীবনে মাত্র একবার হুল ফুঁটাতে পারে, আর যার গায়ে হুল ফুঁটায় সে যদি মোটা চামড়ার কোন প্রাণী হয় তাহলে মৌমাছি নিজেই মারা যায়। হুল ফুঁটালে প্রচন্ড ব্যাথা হয় ঠিক কিন্তু মৌমাছির বিষ এতটা শক্তিশালী নয় যে আমরা মারা যাব.....ব্যাতিক্রম আফ্রিকান খুনে মৌমাছি!
সাধারণ মৌমাছিকে একদল মানুষ আফ্রিকা থেকে ট্রপিক্যাল অঞ্চলে(দক্ষিণ আমেরিকা) নিয়ে গিয়েছিল মধু উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। সেই মৌমাছির একটা দল দূর্ঘটনার কারণে মুক্ত হয়ে যায় আর বনেই আবাস শুরু করে। যা হোক, তাদের ধারনা ভূল ছিল না, আসলেও ট্রপিক্যাল অঞ্চলে মধু উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হল, তার সাথে আরও অনেক কিছুই বেড়ে যায়। দলছুট মৌমাছিগুলো দেখা গেল জঙ্গলে বাস করতে করতে এমনভাবে অভিযোজিত হয়ে গেল, যা তাদের অনেকগুণ বেশি বিপজ্জনক আর মারমুখো করে তুলল। আস্তে আস্তে সামান্য একটা দল প্রায় সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে গিয়েছে। এদের হুলে মানুষের মৃত্যুর অনেক রেকর্ড আছে।
ধারণা করা হয় মৌমাছির বিবর্তন হয়েছে শিকারী বোলতা থেকে। কিন্তু তাদের সামাজিকতার বিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা সামান্য ফাঁকি আছে। আমরা জানি কর্মী মৌমাছিরা প্রজননে অক্ষম। তাহলে ন্যাচারাল সিলেকশন অনুসারে তার কেমন করে নিজেদের উন্নত জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে পাঠাবে?
প্রশ্নটা যেমন মজার, উত্তরটা আরও অদ্ভূত। ধারনা করা হয়, কর্মী মৌমাছিরা যখন রাণী লার্ভার লালন পালন করে, তখন নিজেদের নিকটবর্তী আত্মীয়তার কারণে নিজেদের কিছু জেনেটিক বৈশিষ্ট্য রাণীদের মাঝে পাঠিয়ে দেয়। অর্থাৎ সরাসরি সন্তান জন্ম না দিয়ে শুধু লালন পালনের মাধ্যমে যে সম্পর্ক তৈরী হয় তাতে কর্মী আর রাণী দুজনেরই জেনেটিক উন্নতি ঘটে আর কর্মীদের কিছু জেনেটিক বৈশিষ্ট্য রাণী পেয়ে যায়!
মাঝে মাঝে মৌমাছিদের পাগলামি রোগেও ধরে। তাদের অন্যতম পাগলামির একটা হচ্ছে Colony Collapse Disorder বা CCD। এই ডিসঅর্ডারের কারণে দেখা যায় কিছু কিছু মৌমাছি সন্নাসীদের মত মৌচাক ছেড়ে একা একা অজানার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। আপাতত ধারনা করা হচ্ছে এই অদ্ভূত স্বভাবের জন্য দায়ী Israeli Acute Paralysis Virus।
তারমানে এক সামান্য মৌমাছিই খুব জটিল এক প্রাণী। মৌমাছির বিভিন্ন গাণিতিক দক্ষতা আর মস্তিষ্কের ডিজাইনকে ভিত্তি করে আজকাল চেষ্টা করা হচ্ছে উড়ন্ত রোবটা বানানোর। শার্লক হোমস গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে মৌমাছির ব্যাবসা শুরু করে খুব একটা ভূল করেছেন বলা যাবে না।


[এই লেখাটিও প্রথমে বিজ্ঞান স্কুলে ছিল]

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।