বধূহরণ
কিরগিজস্তান মধ্য এশিয়ার একটি স্বাধীন দেশের নাম। দেশটির ক্ষেত্রফল বাংলাদেশের প্রায় 1.35 গুণ, জনসংখ্যা আমাদের ত্রিশ ভাগের এক ভাগ হতে পারে। অফিশিয়ালি দেশটির ভাষা দুটো, কিরগিজ এবং রাশান। ভারতবর্ষের মত এত প্রাচীন না হলেও কিরগিজদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, নিজেদের মহাকাব্যও রয়েছে।
তাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ বধূহরণ। একটি নির্মম ভয়ংকর প্রথা।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক, আপনি নিজে মেয়ে না হলে আপনার পরিচিত একজন মেয়ের কথা ভাবুন, হলে নিজের কথাই ভাবতে পারেন। একটি মেয়ে পড়াশুনা করে, হেসেখেলে বেড়ায়। একদিন সে রাস্তায় হাঁটছে, হঠাৎ করে একটি গাড়ি তার পাশে এসে দাড়ালো। সে গাড়ি থেকে পাঁচ-ছয়জন লোক বের হয়ে ধুপ করে সেই মেয়েটিকে অপহরণ করে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেলো।
যখন গাড়ি থেকে নামানো হলো তখন সেই মেয়েটি চিৎকার করছে, কারন অপহরণকারীদের কেউ তার পরিচিত নয়। কিন্তু তাকে ধরে আনা হয়েছে তাদেরই কোন একজনের আবাসে, সেখানে মা-মাসিরা আগে থেকেই প্রস্তুত। মেয়েটি হাত-পা ছুড়ছে, ছুটে চলে যেতে চাইছে কিন্তু তাকে জোর করে ঘরের ভেতর নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সেই অপহরণকারীদের একজনের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো সবাই মিলে।
বিয়ের পর ছেলের পরিবারের সবাই মেয়ের পরিবারের কাছে গিয়ে বললো, "আমরা চোর, অপরাধ করেছি। আমাদের ক্ষমা করুন।" মেয়ের পরিবার রাগ করলো, কেউ কেউ দুঃখ করলো, তারপর তাদের সব মেনে নিতে হলো। কারন একরাত ছেলের বাড়িতে কাটানোর পর বধূ কখনও সে বাড়ি থেকে ছিন্ন হতে পারে না তা ওখানকার নিয়ম।
নব্বই দশকের বাজে স্ক্রিপ্টের বাংলা ছবির মত লাগছে শুনতে? বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা করে বলেছে কিরগিজের ৪০-৭০ শতাংশ বিয়ে হয় এভাবে, বধূহরণের বা Bride Kidnapping এর মাধ্যমে। সম্পূর্ন অপরিচিত একজন মেয়েকে অপহরণ করে বাড়ির সবার সাহায্যে বিয়ে করে ফেলা যায়।
হ্যা, ঘটনাগুলো তুলনামূলক অনুন্নত অঞ্চলগুলোতেই ঘটে, বধূহরণকে সরকার বেআইনি ঘোষণা করেছে বেশ আগেই। তাও এরকম ঘটে, কেউ কিছু বলতে পারে না কিংবা বলতে যায় না কারন এটাই নিয়ম, এটাই সংস্কৃতি, এটাই ঐতিহ্য।
এই অপহৃত মেয়েগুলোর কী হয়? অনেক ক্ষেত্রেই বধূহরণের ঘটনাটি ছেলে-মেয়ের আগে থেকে পরিকল্পণা করা থাকে, সহজে বিয়ে করার জন্য তখন একটি নাটক হয় মাত্র। কিরগিজের মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই অবনত অধীনত থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়, অপহৃত হয়ে ধর্ষণতূল্য বিয়ের পর তারা পরিস্থিতি মেনে নিয়ে সংসার করা শুরু করে, সেই সংসারগুলোর সবগুলোই যে অশান্তির হয় তা নয়। কিন্তু তাদের কতগুলোতে সত্যিকারের মানবিক সম্পর্কবোধের অস্তিত্ব রয়েছে তা অনিশ্চিত।
বাকি মেয়েগুলো আত্মহত্যা করে।
আরেকটি তথ্য দেওয়া যাক। বধূহরণ কিরগিজস্তানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নয়।
ভারতবর্ষেই এপ্রকার বিয়ের ইতিহাস রয়েছে। ক্ষত্রিয়মতে কন্যাহরণ করে বিয়ে করা যেতো, তবে সে অতি প্রাচীন কালের কথা। ভারতের একেবারেই অনুন্নত কিছু অঞ্চলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটে, কিন্তু এভাবে গণহারে সামাজিকভাবে বধূহরনের ঘটনা আমি বাংলাদেশ কিংবা তার পাশাপশি অঞ্চলে ঘটতে শুনিনি।
আফ্রিকা অন্য মহাদেশগুলোর তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে তা সত্য, অনেক প্রাচীন নীতি এখনও আফ্রিকার অনেক দেশে টিকে আছে। রুয়ান্ডা, ইথিওপিয়া, মিশর, কেনিয়ায় বধূহরণের ঘটনা ঘটে। কিরগিজস্তানের প্রতিবেশী দেশ কাজাঘস্তানেও হয়। পাকিস্তানে পূর্বে এরকম ঘটনা ঘটেছে, এবং অত্যন্ত বিকৃত রূপে যার ব্যাখ্যায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অনেকে দেশেই এই বর্বররীতি প্রচলিত ছিলো, কিন্তু ইউরোপে বিলিন হয়ে গেছে। সাগর পেরুলে দক্ষিণ আমেরিকার কিছু কিছু দেশের ক্ষুদ্রাঞ্চলে হয়তো এরূপ নিদর্শন আজও পাওয়া যেতে পারে।
২০০৫ সালে পিউতর লম কিরগিজস্তানের বধূহরণের ঘটনা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ধারণ করেন। সেটি ইউটিউবে পাওয়া যাবে Bride Kidnapping in Kyrgyzstan নামে।
নারীর উপর অবিচার মানবসভ্যতার ইতিহাসের অতি প্রাচীন নিয়ম। সেজন্য আজও ধর্ষণ, বিয়ে পরবর্তী নির্যাতনের মত নিকৃষ্ট অপরাধগুলোকে প্রতিরোধ না করে চিকিৎসা করার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গভাষার এক ছবিতে, নাম উল্লেখ করছি না, দেখেছিলাম এলাকার নেতা ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে তার সাথে অন্যায়ের শিকার মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা এরকম যে কেউ জাহাজ থেকে সমুদ্রের পানিতে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, আপনি একটি পাথরের খন্ড পানিতে ফেলে বললেন ওটা ধরে ভেসে থাক।
সমাজ-সংস্কার-প্রথা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য। আমরা কেন এগুলো পালন করি সেটা চিন্তা করে দেখি না। যে সংস্কৃতি মানবতার বিরুদ্ধে সেই সংস্কৃতি পালনের প্রয়োজন নেই। অন্যায় ঐতিহ্য পালন করে পূর্বপুরুষগণের গৌরববৃদ্ধি করার চেয়ে উত্তরপুরুষদের প্রাণরক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সাথে সাথে সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয় এটা আমরা মনে রাখতে পারি না। ফুটবল-ক্রিকেট বাঙালির সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে, মাঠে হাডুডু আর দাড়িয়াবান্দা খেলে কেউ নিজেকে ঐতিহ্যের বাহক মনে করলে তা অযৌক্তিক হবে।
কে জানে কোন রহস্যময় কারনে সমাজবাসী মানুষগণ এখনও প্রথা-সংস্কারের নামে অন্যায়-অনিয়মকে টিকে থাকতে দেয়, জাতিভেদ কিংবা শ্রেণিভেদ তো রীতিমত লাইফ সাপোর্ট দিয়ে জীবিত রাখা হয়েছে। সামাজিক মানবজাতি আজও তার জাতদম্ভে বর্বর আচরণকে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়ে চলেছে।
মুখে গালি চলে এসেছে, সেটা লেখা থেকে বাদ দিলাম।
মানুষ আমরা এখনও খুব বেশিদূর আসিনি, আরও অনেক সামনে যেতে হবে। হয়তো পৃথিবী একদিন সকলেরই বসবাসের যোগ্য হবে, যদি না অর্থলোভী ক্ষমতালিপ্সু মূর্খের দল নিজেদের অন্ধবিশ্বাসের কারনে বৈষ্ণিক উষ্ণতার মত বিপর্যয় ডেকে এনে পৃথিবীকেই ডুবিয়ে না দেয়।
অমরত্ব লাভের ইচ্ছা অতি সামান্য কিছু যদি থাকে তবে তা সেই মুক্ত পৃথিবী দেখে যাওয়ার জন্য।
0 comments: