জলবায়ু পরিবর্তন: অকারন বাক্যব্যয়

 
100 বছরের গ্লোবাল ওয়ার্মিং এক সেকেন্ডে। 
Source: NASA GISS Surface Temperature Analysis by Antti Lipponen



বিষয়টা নিয়ে এভাবে কচলিয়ে সম্ভবত কোন লাভ নেই, কারন আমার কথাগুলো যারা পড়বে তাদের সবাই আমার দলে। জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, যাই বলা হোক না কেন তা যে ঘটছে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্নভাবে এর পক্ষে। মজার কথাটা হলো, অধিকাংশ মানুষ পক্ষ এই কারনে না যে বিজ্ঞান একে সমর্থন দিচ্ছে। মানুষ পক্ষে কারন বাংলাদেশ ভিকটিম। যদি ভিকটিম না হতো তাহলে যতজন মানুষ চায়ের আড্ডায় "এগুলো সব ভুয়া কথা, পশ্চিমা ষড়যন্ত্র" বলতো না তাদের সংখ্যাটি হতো অত্যন্ত নগন্য।

কিন্তু আমরা ভিকটিম। খুব বাজে রকমের ভিকটিম। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ আমাদের দেশে। কিন্তু সারা বিশ্বের মোট কার্বন নিঃস্বরণে আমাদের অবদান মোটামুটি ০.১ শতাংশ। সহজ গাণিতিক ভাষায়, বাংলাদেশের কথা ছিলো যা হয় তার বিশ গুণ কার্বন বায়ুমন্ডলে ছাড়া।

আমরা তা করি না। অবশ্য এর কারন মানুষের অকল্পণীয় সচেতনতা নয়, এর কারন কল-কারখানার স্বল্পতা। কিন্তু এ কথা সত্যি যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম শিকারদের একটি হবে সম্ভবত বাংলাদেশ।

উপরে একটা কথা বলেছি, মানুষ বলতে পারতো বৈশ্বিক উষ্ণতার ধারনাটি পশ্চিমা ষড়যন্ত্র। কিন্তু বললে সেটা ভুল হতো, কারন উত্তর আমেরিকার সাধারন জনগনের বিরাট একটা ভাগই সম্ভবত মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে জলবায়ু পরিবর্তন বলে কিছু নেই, এটা কেবলমাত্র কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের আমেরিকার থেকে টাকা খাওয়ার ধান্দা। কিংবা তারা বিশ্বাস করলেও এর প্রভাব যে কতটা গুরুতর হতে পারে তা বিশ্বাস করে না। যে কারনে তারা কোন প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক একজন মণ্ডূকাকৃতি ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের বিপক্ষে, সে একেবারেই বিশ্বাস করে না যে পৃথিবীর তাপমাত্রা যে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তার বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় যে সে এমন একজন মানুষকে জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে যার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্রার গুরুত্ব কতটুকু সে বিষয়ে কোন ধারনাই নেই!

২ ডিগ্রি সেলসিয়াস লিমিটটা এখন একটু ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি লেখা শুরু করে ছিলাম 'আমেরিকান অবিশ্বাসী'দের উপর সুপ্ত রাগ ঝাড়ার জন্য, এখন সেটা বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। এই অংশে এসে আপনি পড়া বন্ধ করে দিতে পারেন কারন পরবর্তী অংশগুলো সম্ভবত কিছুটা রসকসহীন হবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে আন্দোলন অবশ্যই মানবসৃষ্ট কারনগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীতে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় তা আমাদের মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। কারন "জগতের সকল প্রাণী নিঃশ্বাস নেয় তাই কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ে" এই কথা বলে কেউ যদি মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সব প্রাণী কচুকাটা করে ফেলে তাহলে জগৎ-সংসারের কোন উপকার যে সাধন হবে না এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত।

মানবসভ্যতা থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ইতিহাস শুরু হয়েছে অষ্টোদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে, যখন বিশেষ করে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের শুরু। শিল্প বিপ্লবের আগেভাগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যা ছিলো তাকে বলা হয় Pre-industrial Temperature Level.

আমরা জানি পৃথিবীতে কল-কারখানার সংখ্যা গুণোত্তর হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখন থেকেই। অপ্রাকৃতিকভাবে পাত্তা দেওয়ার মত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির শুরুও সেখানেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত মাত্রার জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, অর্থাৎ তেল-কয়লা-গ্যাস। সে সময় থেকে আধুনিক মানব সভ্যতা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন মেট্রিক টন গ্রিনহাউজ গ্যাস।

প্রশ্ন হচ্ছে সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা কতটুকু বেড়েছে এবং কতটুকু বাড়তে দেওয়া উচিৎ?

শিল্পপূর্ব গড় তাপমাত্রা থেকে ২০১৪ সালের দিকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুব তাড়াতাড়ি এই সংখ্যাটি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌছে যাওয়ার কথা। যদিও এভাবে বলাটি সম্পূর্ন সঠিক নয়, কিন্তু ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে বলা যায় "তুলনামূলক নিরাপদ"। এই পরিমাণটি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে চলে যায় তাহলে বৈশ্বিক উষ্ণতা পৃথিবীর মানুষের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে শুরু করবে।

তাই ২০১৫ সালের জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্রাটি স্থির করা হয়। এর মানে হচ্ছে এই শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত শিল্পপূর্ব গড় হতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর যেতে দেওয়া যাবে না।

এই কাজটি করা সহজ নয়। ২০১৭ সালে নেচারে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রোবাবিলিস্টিক মডেল এবং বেশ কিছু পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেখিয়েছেন ২১০০ শতাব্দী শুরুর আগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকার সম্ভাবনা ৫%, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকার সম্ভাবনা ১%। গবেষণাপত্রটি এখানে পাওয়া যাবে: https://www.nature.com/articles/nclimate3352.

এখন যে প্রশ্নটা অধিকাংশের মনেই আসবে, ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে আসলেই কি কিছু হবে? ২ ডিগ্রি; পাত্তাই তো দিতে মন চায় না। হ্যা, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি মাত্রা পের হয়ে গেলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে এমন নয়। কিন্তু এর প্রভাবটা আসলে যতটুকু মনে হয় তার থেকে অনেক বেশি ভয়ানক হবে।

এর প্রথম কারন হচ্ছে, এটি একটি গড় পরিমাণ। প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিকভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রায় পার্থক্য থাকবে। যে ছবিটি যুক্ত আছে এখানে সে বিষয়টি সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে।

দ্বিতীয় কারনটি হচ্ছে, পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চল একটি নির্দিষ্ট স্কেলের তাপমাত্রার উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি বাড়লে তেমন ক্ষতি হয়তো নেই। কিন্তু মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ার মানে সে এলাকার বরফ যখন গলার কথা ছিলো তার অনেক আগেই গলতে শুরু করা। এবং তাতে সমুদ্র্রতলের উচ্চতা যাবে বেড়ে এবং সমুদ্রতল নিকটবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে ছোট ছোট দ্বীপগুলো যাবে ডুবে।

এমনিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুশির খবর হতে পারতো, কারন অনুমান করা হয়েছে এর ফলে এদিকে ফসল ফলনের হার বেড়ে যাবে। কিন্তু অন্য কারনে সে আশায় গুড়েবালি, সমুদ্রতল থেকে বাংলাদেশের উচ্চতা একেবারেই কম। পানির নিচে কোন ফসল জন্মে না।

পৃথিবীর কপালে দুঃখ আছে। হিলারি ক্লিনটন নামক ব্যক্তিটির যত সমস্যাই থাকুক না কেন, একজন বুদ্ধিমান মানুষের এই একটিমাত্র কারনেই ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া উচিৎ নয়। এই লোক বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী, মৌলবাদী, ক্ষমতালোভী, ইডিয়ট; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই লোক প্রত্যক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। সে সর্বনাশ করলে কেবল আমেরিকার করবে না, পুরো পৃথিবীরই করবে।

আফসোস, সাধারণ আমেরিকান নাগরিকের গড় বুদ্ধিমত্তা বেশি নয়।

সারা পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র একত্রিত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যুদ্ধ করার জন্য, সেটা প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে যে দেশ, চিন, তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। স্বৈরশাসক কিম জং উন এর দেশ উত্তর কোরিয়া স্বাক্ষর করেছে। গৃহযুদ্ধে বিদ্ধস্ত সিরিয়া স্বাক্ষর করেছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সবচেয়ে ছোট দেশ মোনাকো স্বাক্ষর করেছে। যুক্তরাষ্টের স্বাক্ষর করার কথা ছিলো। ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাক্ষর করেনি তা নয়, সে রীতিমত এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে এসেছে!

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে খুব বড় রাজনীতি চলছে। একদিকে বিজ্ঞানীগণ এবং সচেতন মানুষেরা। অন্যদিকে একদল অর্থলোভী-ক্ষমতালোভী এবং নিম্ন বুদ্ধিমত্তার অধিকারী লোকজন। আমাদের দল বেছে নিতে হবে না, আমরা ইতোমধ্যেই প্রথম দলে আছি। এবং এই যুদ্ধে হারলে চলবে না।

কারন হারলে খবর আছে। ভালো রকমের খবর আছে।

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: