দূষিত হিরণ্য

জুলাই ১৪, ২০১৮ , 0 Comments


বাসক বোস বুড়িয়ে গেছেন। তার বয়স আজকেই সত্তর ছুঁলো।
বাসক বোসের একমাত্র মেয়ের নাম কলমি। বাবাকে নিয়ে সে খুব একটা বিপদে যে আছে তা নয়। কোন কঠিন রোগে তিনি আক্রান্ত হননি এখন পর্যন্ত, শরীরের হাড়ও দুশ্চিন্তা করার মত দুর্বল হয়ে গেছে সেটা বলা যায় না।
প্রেসারের সমস্যা একটা আছে বটে, মাঝে মাঝে সামান্য যন্ত্রণাও দেয়। এককালে বাসকবাবুর একটা বাংলা সিরিয়াল দেখার অভ্যেস ছিলো। এগারো বছর আট মাস চলার পর গত দেড় মাস আগে সেই সিরিয়াল কোন উপযুক্ত সমাপ্তি ছাড়াই বন্ধ হয়ে গেছ, জীবনে দুঃখ বলতে আপাতত এই একটাই।
কলমি বেসরকারি একটা অফিসে কাজ করে। সকাল আটটায় বেরুতে হয়, শুক্রবার ছাড়া খবরের কাগজ পড়া হয়ে উঠে না। সেদিন শুক্রবার। খবরের কাগজের ভাজ খুলতেই কলমি দেখতে পেলো নতুন যে আইনটি নিয়ে গত কয়েকমাস ধরে সংসদে তর্কাতর্কি চলছিলো সেটা পাশ হয়ে গেছে। এখন থেকে ৬৫ কিংবা তার বেশি বয়স্ক বৃদ্ধদের পরিবারের লোকজনের সম্মতিক্রমে হত্যা করা যেতে পারে।
কলমি যে বাসক বোসের একমাত্র সন্তান তা আগেই আমরা উল্লেখ করেছি, এখন এও বলে রাখা ভালো যে পরিবারের সদস্যও এই দু'জন। কলমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। আইনটা বাস্তবসম্মত হতে পারে, তবে নিজের জন্মদাতাকে মেরে ফেলা এটাও কেমন কেমন জানি লাগে। এদিকের কথাও ফেলা যায় না, ওদিকের কথাও ফেলা যায় না।
পরদিন অফিসে গিয়ে কলমি শুনলো অ্যাকাউন্টসের রহিম সাহেব দু-তিনজনের সাথে আলাপ করছেন, "দেখেন, এখন তো এসব ছোটখাটো বিষয়ে এথিকস খাটিয়ে আপনি সুবিধে করতে পারবেন না। এটা প্রতিযোগীতার যুগ, টিকতে হলে কিছু কিছু জিনিস মেনেই নিতে হবে। আই মিন, ইটস এ রিজনেবল ডিসিশন। দৃষ্টিকটুর চিন্তা করলে চলবে না। এইযে আমার আম্মা, বুড়ো হয়েছেন চোখে ছানিও পড়েছে, আমারও ফ্যামিলি আছে। কী হবে তাকে দিয়ে? ওয়েস্টেড রিসোর্স। আমি তো গতকালই কাজ সেরে ফেলেছি।"
সবাই সায় দিলো, কেবল রিসিপশনের ইভা বললো, "সেটা ঠিক আছে স্যার, আপনি করেছেন বুদ্ধিমানের কাজই করেছেন। তবে আমার মা আবার আমার সাথে খুব ফ্রেন্ডলি, আমি এ কাজ করতে পারবো না বাব্বা! আমার ভাইদেরও না করে দেবো, হলোই নাহয় একটু বোকামি।"
"হ্যা, তুমি যদি মারতে না চাও মেরো না। তোমার ডিসিশন। বোকামি ডিসিশন, কিন্তু সেন্টিমেন্ট নিয়ে কথা। তাছাড়া এই তোমার মত তিন-চারজনের জন্য দেশের খুব একটা ক্ষতি হয়ে যাবে তাও নয়, দুঃখ করো না।"
ইভা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কলমি নিঃসব্দে আলোচনাটি শুনছিলো, মনোযোগের কারনে বাকিরাও তাকে লক্ষ্য করেনি। এবার ইভার চোখ তার উপর পড়তেই সে হেসে বললো, "এই যে কলমি আপু, কী খবর? আঙ্কেলের বয়সও তো মনে হয় সত্তর হয়েছে, আপনি কোন ডিসিশন নিলেন নাকি?"
"এখনও নেইনি। কাজটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না, হাজার হোক নিজের বাবা। যৌক্তিকতাটা বুঝতে পারছি, কিন্তু এথিকস ঠিক সায় দিচ্ছে না।"
রহিম সাহেব বাঁধা দিলেন, "এইযে এই জায়গাটাতেই সমস্যা, আপনাদের সো কলড স্টোন এজ এথিক্যাল চিন্তার কারনেই দেশের আর আপনাদের ইকোনমিক্যাল প্রগ্রেস কখনো হবে না। আরে ভাই, এটা বাস্তবতার যুগ। আমার বন্ধু রাজের বড়চাচার বয়স হয়েছে আটান্ন, তারা সার্টিফিকেটে আটষট্টি বানিয়ে কাজ সেরে ফেলেছে। সবাই করছে, আপনি না করলে আপনার লস।"
কলমি কোন উত্তর দিলো না কথার।
অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়। অফিস রাস্তার পাশে, সেখান থেকে কলমি বাসে উঠে। আজ অবশ্য বাসে সে উঠলো না, সিদ্ধান্ত একটা নিতে হবে। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু বিনু। কবি মানুষ, তিন-চারটে বইও তার বেড়িয়েছে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলে কলমি বিনুর পরামর্শ চায়। বিনুর বাসা তার অফিস থেকেও খুব বেশি দূরে নয়, হেঁটে চলে যাওয়া যায়।
বাসা পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন অবশ্য পড়লো না। পাড়ার চায়ের দোকানেই কলমি বিনুকে পেয়ে গেলো, আরেকজন মেয়ের সাথে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই বিনু ডাকলো, "কলমি, এদিকে আয়। কী খবর? চা খাবি?"
"খাবো। কথা আছে তোর সাথে।"
বিনু হাসলো, "বল কী বলবি। একে নিয়ে চিন্তা করিস না, আমার শিষ্য। কোন প্রবলেম নেই।"
কলমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। তবে বিনু কবি মানুষ, এসব সে বুঝে নেয়। কলমির সমস্যাটা বুঝতেও তার বেশি সময় লাগলো না, "বুঝলাম তোর কথা। তুই কি আমার অনেস্ট সাজেশন চাস?"
"হ্যা। প্লিজ, অনেস্টলি বল।"
"দেখ, কাজটা সম্ভবত যৌক্তিক, ঠিক আছে। তুই যদি করিস আমি তোকে কোন দোষ দেবো না। কিন্তু আমি তোকে বলবো না করতে, অন্তত আমি এই কাজ করতে পারবো না। আমার নীতিতে বাঁধবে। হ্যা, হয়তো আমি বোকামি করছি, কিন্তু এ কাজ আমার পক্ষে করা সম্ভব না। তবে তোর যদি মনে হয় এটা করলে তোর লাভ হবে, ভালো হবে, তাহলে তুই কর।"
"আমি বুঝতে পারছি না। লাভ তো ধর হবেই, একজনের খাওয়াপরার খরচ তো খুব একটা কমও না। কিন্তু ওই দিকটাও মনে আসছে, তাই তোর কাছে এলাম।"
"আমি তো বললাম। আমি করতে মানা করছি, তবে তুই করলেও যে তোর সাথে আমি কথা বলা বন্ধ করে দেবো এমন না। যাকগে, চা আরেককাপ চলবে নাকি?"
"হ্যা, নিই আরেকটা।"
রাতে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ক্যালকুলেটরে কলমি হিসেবটা করে ফেললো। একজন মানুষের জন্য তার কতটুকু খরচ হচ্ছে, তার অনুপস্থিতিতে কত টাকা বেঁচে যাবে, ঘরও খালি হবে কি না এসব।
কিছু কিছু ছোটলোক যা তা করছে, তাদের মত তো আর কাজ সারা যাবে না। এককালে গোয়েন্দা গল্প কলমি খুব একটা কম পড়েনি আর স্পাই থ্রিলারও না দেখেনি। আর্সেনিক-স্ট্রিকনিন এসব নাম জানাই আছে।
- - - - - - - - - -
তারপর তিনবছর চলে গেছে।
অফিসের রিসিপশনিস্ট ইভার বড় ভাইয়ের ছেলে হয়েছে কিছুদিন আগে। পরশুদিন মেয়েটা চোখ ফুলিয়ে অফিসে এসেছিলো।
কলমি বোস আজকাল কোন অপরাধবোধে ভুগে না। বেচারা বুড়ো হয়েছিলো, প্রেসারের জন্য ভবিষ্যতে কত কষ্ট সইতে হতো। সময় কাঁটানোরও কিছু ছিলোনা, শখ করে নাটক দেখতেন সেটাও বন্ধ হয়ে গেলো। মারা গিয়ে বেঁচে গেছেন।

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: