কুমড়া-কথন

জুলাই ১৭, ২০১৮ , 0 Comments


 “বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।“

“ভালো করেছেন নৃপতিবাবু। ছোট বিপদে পড়ে আমার কাছে কেউ আসলে আমি অপমানিত বোধ করি।“

আমি যার সামনে বসে আছি তিনি একজন জাদুকর। সত্যিকারের জাদুকর। প্রচারবিমুখ মানুষ, তাই তার খোঁজখবর সাধারণ মানুষজন খুব একটা রাখে না। নিজের খোঁজখবর বাইরে দেয়ার খুব একটা প্রচেষ্টাও উনার কোনকালে ছিলো না। খাওয়াপরার চিন্তা নেই, হাত ঘুরালেই মাছ-মুরগী আসছে, দা-চাকুগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে নিজেরাই দুর্ভাগা প্রাণীগুলোর গর্দান নিচ্ছে, চুলাতে গ্যাস ছাড়াই আগুন জ্বলছে। তুড়ি মারলেই নতুন-নতুন জামাকাপড় তৈরী হচ্ছে, জুতো-মোজা এসব উদয় হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের আর কি প্রয়োজন হতে পারে? জাদুর জামাকাপড় হওয়ার কথা পুরনো ধাঁচের, কিন্তু কি চমৎকার তিনি পরে আছেন ফ্রান্স ফুটবল দলের জার্সি।

জাদুকর সাহেবের নাম আমি বলবো না। প্রচারবিমুখ মানুষ, শুধু শুধু তার খ্যাতি বাড়িয়ে লাভ নেই। বেশি লোকজন এসে বিরক্ত করলে পরে হয়তো আমার উপর ক্ষেপে যাবেন। তখন সারাজীবন আমার অভিশাপ বহন করেই শেষ হয়ে যাবে।

এঁকা এঁকা থাকেন কি না, মাঝে মাঝে মানুষজন দেখা করতে আসলে একটু গল্প করার ইচ্ছে করতেই পারে। জাদুকর সাহেব একটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে আমাকে বললেন, “সিগারেট টানার সামান্য বদভ্যাস আছে আমার, তাই আপনাদের উপকার করে আজও কিছু দক্ষিণার আশা করতে হয়। আমাদের সিস্টেমের এই একটা মৌলিক সমস্যা। জাদুমন্ত্রগুলো তৈরী হয়েছে সেই প্রাচীন কালে, সিগারেট তখন ছিলো না, বাতাস থেকে সিগারেট বানানোর মন্ত্রও তাই কেউ বানায়নি।“

“কাঁচামাল যোগাড় করে আপনি নিজে নিজেই তো বানিয়ে নিতে পারেন, খুব একটা কঠিন কাজ তো নয়।“

“সে চেষ্টা কি করিনি ভাবছেন? করেছি, করেছি। কিন্তু জিনিসটার তো একটা ফ্লেভার আছে রে ভাই। তাছাড়া আমরা আদ্যিকালের মানুষ, আমাদের বানানো সিগারেট আর ফ্যাক্টরির ব্র্যান্ড কি একরকম হবে?”

কথাটা ভুল নয়, আমি তাই কোন তর্কে গেলাম না, “যাকগে, আমার সমস্যাটি এবার কি শুনবেন?”
“কেন নয়? শুভস্য শীঘ্রম।“

সমস্যাটি খুব যে জটিল তা নয়। আমার গেঁয়ো ফুফাতো বোনের নাম জনা। গেঁয়ো মানে বদ্ধ গেঁয়ো। মানুষ শখ করে রান্নাবান্না করে, শখ করে সাজগোজ করে। জনা শখ করে গোবর দিয়ে ঘুটে বানায়।
জনার অতিদুঃসম্পর্কের এক দাদু ছিলেন। বুড়ো ধান আর পাটের ব্যাবসা করে বহু টাকা জমিয়েছিলেন। সে টাকা দিয়ে শহরে বিশাল বড় বাড়ি বানিয়েছিলেন। বেচারার প্রথম পত্নীর কোন ছেলেমেয়ে হওয়ার আগেই মারা গেলো। দ্বিতীয় পত্নীও কেমন কেমন করে যেন কোন ছেলেমেয়ে হওয়ার আগেই মারা গেলো। বয়স তখন কম নয়, বুড়ো ছেলেমেয়ের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো, যা হোক একটা কিছু হলেই তার চলে যেতো। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, তৃতীয় পত্নী সেই যা কিছু একটা জন্মানোর সুযোগ দেয়ার আগেই পুরনো প্রেমিকের সাথে কোথায় যে পালিয়ে গেলো কেউ বলতে পারে না।

বুড়ো মরলেন। বুড়োর বাড়ির মালিক হলো জনা। গেঁয়ো মেয়ে, বাড়ি দিয়ে কী করবে? আমরাই থাকি, বাড়ির দেখাশোনা করি, ভাড়া আদায় করি। এত বড় বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ অতিমাত্রার ধৈর্য্য, খরচ এবং পরিশ্রমের কাজ। তবু আমরা জ্ঞাতিগোষ্ঠী, জনা বিধবা মেয়েছেলে, খেয়াল তো আমাদেরই রাখতে হবে। নিজেরা না খেয়ে না পরে বহুকষ্টে চার-পাঁচহাজার টাকা জমিয়ে জনাকে পাঠাই। গেঁয়ো মেয়ে, চার-পাঁচহাজার টাকা আমাদের হিসেবে লাখের নিচে হবে না।

তবে গেঁয়ো হলে কী হবে, মেয়ে মানুষ তো! জাতটাই অকৃতজ্ঞ, আগাগোড়া অকৃতজ্ঞ। গত কয়েকমাস ধরে জনা টাকা বাড়াতে বলছে। এত কষ্ট করে কিছু টাকা জমাই, সেগুলো পাঠাই শালিকে। নোংরা গালি মুখে এসে যাচ্ছিল, কিন্তু রূচিশীল ব্যক্তিগণ শুনলে দুঃখ পাবেন বলে এযাত্রায় মনের বাক্য প্রকাশ করা থেকে বিরত রইলাম।

জনার এই অন্যায় আব্দারের কঠিন দণ্ড যে প্রাপ্য হয়েছে সে চিন্তা আমাদের হিতৈষী গণের মাথায় বেশ কিছুদিন ধরেই ঘুরছিল। সত্যি বলছি, আমরা ভালোলোক। শাস্তির উদ্দেশ্য কেবলমাত্র সামান্য শিক্ষাদানের আয়োজন, আর কিছু নয়। অন্য কেউ হলে খুন করে ফেলতো, আমরা কাছের লোক তো তা করতে পারি না। নির্বোধ মেয়েছেলেটার উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করতেই তাই আজ জাদুকর সাহেবের কাছে আমি এসেছি।

তবে এসে কোন উপকার না হলেও খুব বেশি ক্ষতি নেই, অনেক নতুন কিছু দেখতে পেলাম। আমার কথা শুনতে শুনতেই তিনি চায়ের ব্যবস্থা করলেন। প্যাকেটের প্রসেস করা চা নয়, একেবারে জাদুর তৈরী তাজা পাতার চা। দুধ মেশালেন সেটাও বাঙালি গরুর নয়, একেবারে নরওয়েজিয়ান লাল গরুর। তিনি চিনি খান না, আঙুলের তুড়িতেই চা মিষ্টি হয়ে গেলো। সত্যি বলছি, এত সুস্বাদু চা আমি জীবনেও খাইনি।

চা হলো। আমার কথা জাদুকর সাহেব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, একটা নোটবুকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নোটও করলেন। তারপর গল্প শেষ হলে বললেন, “ভালো কেস। চিন্তা করার কিছু নেই, অনেক উপায় আছে। হত্যা করতে চান না শত্রুকে, আনন্দ পেলাম, আপনারা সুবিবেচক। তো সমাধান করে দিচ্ছি, পুরনো পদ্ধতি কিন্তু কার্যকর। আপনার ফুফাতো বোনকে জাদুকরে খেঁকশিয়াল বানিয়ে দিই।“

আমি আঁতকে উঠলাম, “না, না, কি সর্বনাশ! খেঁকশিয়াল হয়ে যদি কাঁমড়াতে আসে? পরে জলাতঙ্ক হয়ে মরি আরকি। তাছাড়া, হঠাৎ করে একটা মানুষ উধাও হয়ে গেলে দশজন নানা কথা বলবে, আমাদের দোষ দেবে। আপনি অন্য উপায় করুন জাদুকর সাহেব।“

“তাহলে এক কাজ করি, সবজি বানিয়ে দিই।“

“সবজি? সে তো ঘুরেফিরে একই কথা।“

“এক কথা না, এ অন্যরকম জাদু। ব্যক্তি দেখতে মানুষের মতই থাকবে, কিন্তু সে নিজেকে মনে করবে সবজি। মানুষের সদিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন এসব থাকে – সবজির থাকে না। খেতেপরতে দেবেন, চুপচাপ এ নিয়েই খুশি থাকবে। একটা আলু-পটল তো আর আপনাকে এসে বলবে না ডিম দাও, শাড়ি দাও, চুড়ি দাও। কী মনে হয়?”

আমি চুপ হয়ে বিবেচনা করে দেখলাম এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না। সবজির চেয়ে নিরাপদ কিছু নেই। সবজিরা রান্নাঘরে পড়ে থাকে, বাজারের ব্যাগে ঢুকে থাকে। গাছে থাকতে এরা শুধু সাইজেই বাড়ে। এদের কিছু চাওয়ার ক্ষমতা নেই, কেঁটে ঘন্ট কিংবা বড়া বানালেও তারা কিছু বলতে পারে না।

আমি খুব খুশি হলাম, “সত্যি এটা করা যাবে?”

“আলবৎ যাবে! না গেলে আমি আপনাকে বলবো কেন? মানুষ থেকে সবজি বানাতে পারি, আবার মানুষ সবজি হয়ে গেলে আগের অবস্থাতে ফিরিয়েও আনতে পারি। এসব পানিভাত।“

আমার চোখ কপালে উঠলো, “মানুষ নিজে নিজে সবজি হয়ে যায়?”

“হবে না আবার? ওই তো পরশুদিন, একজনকে ঠিক করে দিলাম। বেচারা পড়াশুনা করে নি, কেমন কেমন করে যেন তার মনে হতে লাগলো সে একটা হল্যান্ডের আলু। তার আবার জন্ম হয়েছে কোনো এক ক্ষেতে, সেই ক্ষেতের চাষী আবার একটা পাঁচ পা-অলা বক। বেচারা ভয়েই বাঁচে না, কোনদিন তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলে।“

“বলেন কি!”

জাদুকর সাহেব রহস্যময় হাসি হাসলেন। লোকটির উপর শ্রদ্ধা আমার বাড়তেই লাগলো। সত্যি, কত গুণী মানুষ আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ান, আমরা টেরও পাই না। জনার সমস্যা দূর হলে আবার এসে উনার সাথে দেখা করে যেতে হবে। ক্ষমতাবান মানুষের সুদৃষ্টি থাকলে ক্ষতি নেই, বরং ভালো।
তিনি প্রশ্ন করলেন, “কোন সবজি হলে ভালো হয়?”

আমি একটু চিন্তা করলাম। জনা বাচ্চাকালে বেশ গোলগাল ছিলো, এখনও যে সরু পাটকাঠি হয়েছে তাও নয়, “মিষ্টি কুমড়া কি সম্ভব?”

“কেন নয়? সবকিছুই সম্ভব।“

“তাহলে জাদুকর সাহেব দয়া করুন। মিষ্টি কুমড়াই বানিয়ে দিন, আপনার উপযুক্ত দক্ষিণার ব্যবস্থা আমি করছি।“

জাদুকর সাহেব বিনয়ের হাসি ফুঁটালেন মুখে, “আহা আহা, ওসব কথা আসছে কেন আবার? ওই দক্ষিণা নিয়ে ভাববেন না। মাঝে মাঝে এটা-ওটা নতুন জিনিস খাওয়ার শখ, সিগারেটটা কিনতে হয়, তাই দক্ষিণার ব্যবস্থা। অন্য সময় হলে আপনাদের উপকার করে টাকা নেয়ার চিন্তা করতেই লজ্জায় মরে যেতাম। আজকাল যুগ পাল্টেছে, আমাদের জাদুকরদেরও মাঝে মাঝে অর্থকড়ি লাগে। কী আর করার আছে, বলুন?”

জাদুকর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। প্রাচীন ঈন্দ্রজালের মহান এই সাধকের দিকে আমি কেবল মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েই রইলাম।

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: