দুষ্টস্বর

সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮ , 0 Comments


রাজদরবারে চাকরিটা পেয়ে চটকু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

তিনবছর হলো সে পড়াশুনার পাট চুকিয়েছে। বিদ্যাপীঠে চটকু ঠিক কোন বিদ্যা রপ্ত করেছে তা তাদের বাড়ির কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। পাড়া প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলে তার মা মাথা চুলকোতে চুলকোতে উত্তর দেয়, “ওই যে কীসব কঠিন কঠিন নাম বলে, আমার কি তা মনে থাকে নাকি? এসব প্রশ্ন চটকুকে গিয়েই জিজ্ঞেস করগে।“ তাদের মধ্যে অতি-উৎসাহী কেউ কেউ চটকুকে প্রশ্ন করেও রহস্যের কোন কূলকিনারা করতে পারলেন না। চটকু বিদ্রূপের হাসি হেসে উত্তর দিলো, “ওসব কঠিন কঠিন বিষয়, আপনারা বুঝবেন না।“

খেয়ে-পরে ভালোই যাচ্ছিলো, কিন্তু মাঝখান থেকে ফ্যাসাদটা লাগালেন চটকুর বুড়ো বাপ। একদিন রাতে ঢেঁড়স দিয়ে শোল মাছ আর মুগের ডালের চচ্চড়ি খেয়ে বৃদ্ধ সেই যে ঘুমোলেন, পরদিন শত ডাকাডাকি আর মরাকান্নাতেও তার ঘুম ভাঙলো না। চটকুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তার বাবা এমন কোন আহামরি টাকাওলা মহাজন ছিলেন না যে পৈত্রিক সম্পত্তি ভেঙে বহুবছর হেসে-খেলে কাটিয়ে দেয়া যায়, তার উপর নিজের ছোট দুটো বোনও আছে। আলসেমি ভেঙে সে তাই কাজের খোঁজে নেমে গেলো।

খুব বেশি কষ্ট অবশ্য করতে হলো না। চটকুর মামা আছেন রাজদরবারের দ্বাররক্ষক, ছয়মাসের মাঝে তিনিই চাকরির ব্যবস্থাটা করে দিলেন। খুব একটা কঠিন কাজ নয়, পদের নামটাও বেশ জম্পেশ ‘রাজকীয় টেপবাহক’। পাড়াভর্তি সকল মানুষকে মিষ্টি-রসগোল্লা যথেষ্টই খাওয়ানো হলো, সকলে বলাবলি করতে লাগলো ছেলেটার হবে।

তারপর শুভদিনে চটকু নতুন চাকরিতে যোগ দিতে রাজদরবারে গমন করলো। বিশাল রাজদরবার, সেখানে কত সভাসদ, কত সৈন্য-সামন্ত আর কত রাজ-অনুগ্রহ প্রার্থী তার কোন হিসেব নেই। মামাকে সালাম করে চটকু অবাক হয়ে সবকিছু দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর একজন স্যুট-টাই পরা লোক এসে তার হাতে রাজার চিহ্ন ছাপানো একটি কালো রঙের মোটা ডাক্টটেপ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ওই কোণায় দাঁড়িয়ে থাক, ডাকলেই ছুটে চলে আসবি।“

মহারাজের নাম ভঞ্জাদিত্য দুর্দণ্ডকানুন! রাজদরবারের সকলেই বলেন, “রাজার মত রাজা!” কর্মচারীরা তার ব্যাপারে কী ভাবে সে নিয়ে মহারাজের অশেষ কৌতূহল। কোন কোন দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, “কাল যখন আমি কবিতা পাঠ করছিলাম তখন অর্থমন্ত্রী আর শিক্ষামন্ত্রী কী বলাবলি করছিলো?” প্রধানমন্ত্রী হেসে উত্তর দেন, “ওই তো, তেমন কিছু না। তারা বলছিলেন যে আপনার মত বিদ্বান এবং বিচক্ষণ সাহিত্যপ্রেমী শাসক যদি প্রতিটি দেশে থাকতো তাহলে সারা দুনিয়াটাই সুজলা-সুফলা হয়ে যেতো।“ রাজা খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তাই নাকি? বাহ, মন্ত্রীদের কাজকর্মে মনোযোগ আছে তাহলে। ওদের টমটমের জন্য আরবদেশ থেকে কয়েকটা ঘোড়া আনানোর ব্যবস্থা কর। আচ্ছা, সকালে ওই বাচ্চা চোরটাকে যে শূলে চড়ানোর আদেশ দিলাম, তখন যোগাযোগমন্ত্রী আর আইনমন্ত্রী ফিসফাস করছিলো দেখলাম। বেশি কঠিন শাস্তি হয়ে গেলো নাকি?”

“একেবারেই না হুজুর। তারা বলছিলো যে আপনার মত দয়ালু, মিষ্টভাষী, ক্ষমাশীল রাজা কোন দেশে নেই। পাশের দেশে এই অপরাধের জন্য তো নির্ঘাত আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো ব্যাটাকে।“

রাজা আরও খুশি হয়ে গেলেন, “বাহ! আমার মন্ত্রীরা সত্যিই দক্ষ এবং বিশ্বস্ত। এক কাজ কর, সব মন্ত্রীকে দুইজন করে দাসী দান করে দাও। ভালো কথা, প্রজারা কী বলে আমার ব্যাপারে? মাঝে মাঝে দু-একজন কমবয়সী মেয়েছেলে যে তোমরা সপ্তাহখানেকের জন্য ধরে আনো তাদের সবাইকে কাঁদতে দেখে আমি খুবই কষ্ট পাই। প্রজারা আপত্তি করে না তো আবার? দেখ, আমি কিন্তু প্রজাদের ভালোই চাই। প্রজার থেকে রাজার ত্যাগ বেশি থাকা উচিৎ। তেমন হলে আমি কষ্ট করতে রাজি আছি, তিন সপ্তাহ পরপর নয় দরকার হলে তিনমাস পরপর নতুন সেবিকার ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু প্রজাদের কষ্ট হতে দেবো না।“

মন্ত্রী একটি কাঠি দিয়ে কান পরিষ্কার করতে করতে বলেন, “আরে না না, ধুর। প্রজাদের আবার কষ্ট কী? চাষা-চামার ঘরের মেয়ে, রাজসেবার সুযোগ পেলে তারা খুশিই হয়। কান্না যেটা দেখেন সেটা আনন্দের। আপনি ভাববেন না, প্রজারা খুশি আছে।“

প্রজারা ভালো আছে শুনে রাজা স্বস্তি পান।

এতদিন রাজদরবারে আসার সুযোগ হয় নি বলে মহারাজের এত গুণাগুণ সম্পর্কে চটকু ঠিক অবগত ছিলো না, সভার বাইরে রাজচিত্র দেখতে একটু অন্যরকমই লাগে। কিন্তু রাজা ভঞ্জাদিত্য যে প্রকৃতপক্ষেই একজন ন্যায়বিচারক তার প্রমাণ সে প্রথমদিনেই পেয়ে গেলো।

নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোষণা হলো, “দিগ্বিজয়ী মহারাজ ভঞ্জাদিত্য দুর্দণ্ডকানুন দয়ার সাগর বিদ্যারত্ন রাজসভায় প্রবেশ করছেন।“ সাথে সাথে খুব হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো। সভাসদ যাদের বসার ব্যবস্থা ছিলো তারা সবাই দাড়িয়ে গেলেন। একদল লোক কোথা হতে উদয় হয়ে হঠাৎ দারুণ বাদ্য-বাজনা শুরু করে দিলো। এক টেকো লোক চিৎকার করে বলতে লাগলো, “মহারাজের”, আর তার পিছনে যে বিশ-পঁচিশজন ছিলো তারা চেঁচিয়ে বললো, “জয় হোক!” মহারাজ দরজা দিয়ে ঢুকতেই কয়েক জোড়া তরুণী তার মাথার উপর কৃত্রিম পুষ্পবৃষ্টি শুরু করে দিলো। এভাবে মহা-আড়ম্বরে রাজসভায় প্রবেশ করে মহারাজ ভঞ্জাদিত্য সিংহাসনে বসলেন। তিনি বসতেই প্রধানমন্ত্রী একটা ইশারা করলেন আর সাথে সাথে সবকিছু নীরব হয়ে গেলো।

মহারাজ বসেই বললেন, “সকালের খাবারটা ঠিক জুতের হয় নি।“

সাথে সাথে খাদ্যমন্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন, “তাহলে রাঁধুনিটাকে ছাড়িয়ে দেই?”

“না না, রান্না নিয়ে সমস্যা হয়নি। কাল রাতে দু’টো পান খেয়েছিলাম, তারপর মুখে স্বাদ পাচ্ছি না।“

সবাই আহা-উহু করতে লাগলো। মহারাজ বললেন, “যাকগে, এসব কথা থাক। সভা শুরু কর। কই, কার কী সমস্যা তাড়াতাড়ি বল।“

প্রধানমন্ত্রী আবার ইঙ্গিত দিতেই পেয়াদারা ধরে-বেঁধে একজন পাকাদাঁড়ি বুড়োকে নিয়ে এলো। চটকু এই বুড়োকে চিনতে পারেনি, কিন্তু সভার বাকি সবাই যে খুব অবাক হয়েছে সেটা বুঝতে পারা গেলো। স্বয়ং মহারাজ সিংহাসন থেকে লাফিয়ে উঠে পড়লেন, “একি! এ যে বার্তামন্ত্রী! উনাকে ধরে এনেছ কেন?”

প্রধানমন্ত্রী বললেন, “বুড়ো হয়েছেন তো, আজকাল আবোল-তাবোল বকছেন। তাই ধরে আনা হয়েছে।“

এ কথাশুনে বার্তামন্ত্রী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “কত বড় স্পর্ধা আপনার! আমি আবোল-তাবোল বকছি? আপনি কোথা থেকে উড়ে এলেন জানি না, আমার পরিবার গত দশ প্রজন্ম ধরে এ রাজত্বের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছি। আবার ঠাকুরদা ছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী, সেটা জানেন?”

রাজা বললেন, “আহা, এসব বন্ধ করো তোমরা। বলুন বার্তামন্ত্রী মশাই, আপনার কথা কী?”

বার্তামন্ত্রী বললেন, “ক্ষমা করবেন মহারাজ। বার্তাদপ্তরের প্রধান-কর্মচারী কিছুদিন আগে গত হয়েছেন। নিয়োগ দেয়ার মত অসংখ্য দক্ষ লোক ছিলেন, কিন্তু মন্ত্রীমশাই সেখানে নিজের জামাতাকে চাকরি দিয়ে দিয়েছেন। সেই ছেলে কাজকর্ম কিছু পারে না, সারাদিন খালি ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ায় আর কারণ-অকারণে ছড়ি ঘুরায়। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম কেবল, তাই আমার এই দশা।“

একটি কথা বলে রাখা ভালো, প্রধানমন্ত্রী কুশলরত্নের এই জামাতাটি প্রকৃতপক্ষে মহারাজের ভাগ্নে। নিজের বোনের সুপুত্রকে নিয়ে বার্তামন্ত্রীর কথাবার্তা তাই তার ঠিক পছন্দ হলো না, “প্রধানমন্ত্রী যখন নিয়োগ দিয়েছেন তখন ভেবেচিন্তেই দিয়েছেন। সেখানে আপনার আপত্তির বিষয়টা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না আমার কাছে। না না, এধরনের আচরণ ঠিক নয়।“

প্রধানমন্ত্রী এ ফাঁকে ফট করে বলে উঠলেন, “বুড়ো হয়েছেন, বেশি কথা বলছেন। মহারাজ, মন্ত্রীমশাইয়ের মুখে টেপ মেরে দিলে কেমন হয়?”

কথাটি বলার সাথে সাথে পুরো রাজসভা থেকে শত শত সমর্থন আসতে শুরু করলো। এই রসকষহীন বুড়োমন্ত্রীর উপর কেউই ঠিক সন্তুষ্ট ছিলেন বলা যায় না। রাজা খুশি হয়ে বললেন, “অতি উত্তম প্রস্তাব! কই, টেপবাহক কই?”

মহারাজ এ কথা বলার সাথে সাথে চটকু ছুটে এসে টুপ করে একটি সালাম ঠুকে দিলো, “হাজার সালাম, মহারাজ।“

“তোকে তো আগে দেখিনি মনে হচ্ছে। নাম কী রে তোর?”

“জী, চটকু।“

প্রধানমন্ত্রী কানে কানে বললেন, “এই ছেলে মহারাজ আপনার বিশ্বস্ত দ্বাররক্ষক রহমত মিয়ার ভাগ্নে। রহমত সুপারিশ করলো, বললো পড়াশুনা জানা ভালো ছেলে, তাই চাকরিটা দিয়ে দিলাম।“

“ভালো করেছ। ছেলেটাকে দেখে মনে হয় বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। তা চটকু, দেখি তুই কেমন কাজ পারিস। যা, মন্ত্রীমশাইয়ের মুখে একটা টেপ লাগিয়ে দে।“

কিছুদিন ধরেই টেপ লাগানোর কাজটি চটকু নিজের বাড়িতে প্র্যাকটিস করেছে। সে খুব সুন্দর করে তার ডাক্টটেপের রিলটি থেকে একটুকরো টেপ কেটে নিয়ে মনোযোগ সহকারে বার্তামন্ত্রীর মুখে লাগিয়ে দিলো। লোকটার মুখভর্তি দাঁড়ি, কিন্তু ভাগ্যগুণেই হোক কিংবা জন্মগত প্রতিভার কারণেই হোক সে টেপ একেবারে নিখুঁত ভাবে লেগে গেলো। বার্তামন্ত্রীর মুখ দিয়ে কেবল গোঁ গোঁ শব্দ বের হতে লাগলো, কোন কথা তিনি বলতে পারলেন না।

চটকুর কাজ দেখে মহারাজ খুবই খুশি হলেন, “আরে বাহ! এই ছেলে তো খুব সুন্দর টেপ লাগিয়েছে। ও হে রহমত, তোমার ভাগ্নে তো চালাক-চতুর আছে। কী সুন্দর টেপ লাগিয়েছে!”

দরজার প্রান্ত থেকে রহমত মিয়া বললো, “সবই আপনার দয়া, মহারাজ।“

রাজা চটকুর দিকে তাকালেন, “মন দিয়ে কাজ করতে থাক ব্যাটা, তোর উন্নতি হবে। মন্ত্রী, ওর বেতন কয়েকশ টাকা বাড়িয়ে দাও।“

এ কথা শুনে চটকুর মনে নতুন করে রাজভক্তির উদয় হলো। বিদায় নেয়ার সময় সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তার মাথা এতটাই নিচু হয়ে গেলো যার পুনরাবৃত্তি করতে সাধারণ মানুষদের রীতিমত কসরত করতে হবে।

তারপর রাজদরবারে চটকুর চাকরি পাকা হয়ে গেলো।

টেপবাহকের কাজটিকে প্রথম প্রথম কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেও আস্তে আস্তে সকলেই বুঝে গেলেন যে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কমই হয়। রাজশাসন প্রতিষ্ঠা করতে টেপ মারার বিকল্প আর নেই। শুরুই তো এক মন্ত্রীকে দিয়ে, তারপর একের পর এক দোষীর মুখে চটকু টেপ লাগানোর দায়িত্ব পেতে থাকলো। তাদের কেউ কেউ রাজাকে নিয়ে কটূক্তি করেছে। সত্যি সত্যিই কটূক্তি করেছে কি না তা বুঝার কোন উপায় নেই, কিন্তু টেপ লাগানো যেহেতু তেমন ব্যয়বহুল কোন শাস্তি নয় তাই সবার মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়া হলো। মাঝে মাঝে দু-একজন পাঠশালার পণ্ডিত শাসনপদ্ধতির সমালোচনা করে ফেললেন এবং তীক্ষ্ণ ভাষায় ঘোষণা দিলেন রাজ্যের ধন-সম্পদ সব যাচ্ছে রাজা আর মন্ত্রীদের পকেটে, সাধারণ মানুষ পাচ্ছে ঠনঠন। তাদের ধরে মুখে কেবল টেপই মারা হলো না, কয়েক ঘা চাবুকও পেটে-পিঠে মারা হলো।

তবে কেবল গুরুপাপী নয়, কিছু লঘুপাপীর দেখাও পাওয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী কুশলরত্ন উচ্চতায় একটু খাটো প্রকৃতির, তিনি রাস্তায় বের হলে তাকে দেখে কিছু মানুষ হাসাহাসি করে বলে তার ধারনা। ওদের কয়েকজনকে ধরে এনে মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়া হলো। রাজকবির কলম দিয়ে আজকাল রাজপ্রশংসা ছাড়া আর কিছু বের হয় না। তার কাব্যের সমালোচনা করলেন যে কয়েকজন কবি তাদের মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়া হলো। কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে মাঠে হৈহৈ রৈরৈ করে হাডুডু খেলে, আর মাঠের পাশেই ক্রীড়ামন্ত্রীর বাড়ি। ওই বাচ্চাগুলোকে এনে মুখে টেপ লাগানো হলো, লাগানোর পর মন্ত্রীমশাই ওদের গালে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড়ও বসিয়ে দিলেন।

চটকু কোন প্রশ্ন করে না। সে মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করে। প্রথম মাসের বেতন পাওয়ার পর সে নিজ খরচে নতুন কাঁচি কিনেছে আরও নিখুঁতভাবে টেপ কাটার জন্য। আজকাল এ কাজে তার দক্ষতা এতটাই বেড়েছে যে আশেপাশের কেউ ঘরে টেপ দিয়ে ছবি-পোস্টার লাগাতে চাইলেই চটকুকে ডাকে। চটকু গিয়ে চা-মুড়ি খায় আর টেপ মেরে আসে।

প্রধানমন্ত্রীর সাথেও চটকুর মোটামুটি খাতির হয়ে গেছে। একদিন সভা শেষ হওয়ার পর তিনি চটকুর কানে ফিসফিস করে বললেন, “সন্ধ্যার দিকে কোষাগারের ওদিকে আসিস। ভালো দেখে এক রিল টেপ সঙ্গে রাখিস।“ সময়মত হাজির হয়ে সে দেখলো মন্ত্রীসাহেবের লোকজন এক বোকাসোকা কেরানিকে ধরে রেখেছে। তহবিল থেকে কিছু টাকা মন্ত্রীমশাই একটু গড়মিল করেছিলেন। এই কেরানি বিষয়টা বুঝতে পারেনি, টাকাটা সে প্রধানমন্ত্রীর বেতন থেকে কেটে রেখে দিয়েছিলো। বিষয়টা বাইরে জানাজানি হলেই সমস্যা। চটকু নিঃশব্দে সেই কেরানির মুখে টেপ মেরে দিলো। মন্ত্রীমশাই তাকে একটা পুরষ্কারও দিলেন, সে টাকা দিয়ে নিজের দুই ছোট বোনের জন্য দু’টো নতুন শাড়ি কিনে নিয়ে চটকু সেদিন বাড়ি ফিরলো।

চটকুর বোনেরা শাড়ি পেয়ে খুব খুশি, তারা আর একটু বড় হলে মনে হয় ভাইকে মাথায় নিয়ে নাচ শুরু করতো। তাদের বিধবা মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “এই দিনটা উনি দেখে যেতে পারলেন না। বাবা আমার, এবার তুই একটা বিয়ে কর।“ চটকুর বোনেরাও বললো, “হ্যা রে ভাই, এবার আমাদের জন্য একজন ভাবী নিয়ে আয়।“

তখন হাসিঠাট্টা করে উড়িয়ে দিলেও কথাটা আসলে চটকুর মনে ধরলো। সুতরাং তিনমাস পর রাজসভার অন্য এক কর্মচারীর মেয়ের সঙ্গে চটকুর বিয়ে হয়ে গেলো।

চটকুদের কয়েকঘর পরেই গঙ্গাচরণের বাড়ি, বিয়ের ঠিক এক দিন আগে গঙ্গার ষোড়শী মেয়েটি মহারাজের বাগানবাড়িতে আশ্রয় লাভ করলো। সেই কন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় চটকুর বিয়েতে মহারাজ উপস্থিত থাকতে পারলেন না, তবে দূত মারফত আশীর্বাদ ঠিকই পাঠিয়ে দিলেন।

বিয়ের তিন সপ্তাহ পর আবার প্রধানমন্ত্রী তাকে ডাকলেন, “কী হে বাপু, বিয়ে করেছ শুনলাম?”

চটকু হাত কচলাতে কচলাতে জবাব দিলো, “তা হুজুর আপনাদের আশীর্বাদ যখন আছে, ভাবলাম এর চেয়ে ভালো সময় আর কেমন করে হবে?”

“হু। তো বিয়ে করেছ, ভালোই করেছ। নতুন সংসার, লাগলে বলো তোমার বেতন কিছুটা বাড়িয়ে দেবো। যাকগে, একটা কাজ করতে হয় যে।“

“অবশ্যই হুজুর! কী কাজ বলুন কেবল।“

“তোমাদের পাড়া থেকে কিছুদিন আগে একটা মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেবা-টেবা করার জন্য আর কি। তো তার চাকরি শেষ হয়েছে, এবার বাড়িতে ফেরত পাঠাতে হয়। এসব কাজ আমিই করি সাধারণত, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ বয়স হয়েছে, এত কষ্ট আর সহ্য হয় না। তুমি একটু মেয়েটাকে দিয়ে এসো, কেমন?”

প্রধানমন্ত্রীর আদেশমত চটকু সেদিনই কন্যাটিকে গঙ্গাচরণের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলো। তারপর বাড়িতে গিয়ে কাঁচকলা ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তার নতুন বউ পেঁয়াজ-মরিচ মিশিয়ে খুব ভালো কাঁচকলা ভর্তা করতে পারে।

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। একবছর পর চটকুর একটি ছেলে হলো।

রাজকীয় টেপবাহকের কাজও একটু কমে গেছে। মুখে টেপ মারতে মারতে এমন অবস্থা হয়েছে যে খুব বেশি মানুষ বকবক করার সাহস পায় না। রাজসভার লোকজন দেখলে দেশের মানুষজন মুখ চেপে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, যদি ভুল করেও কেউ কিছু বলে ফেলে তাহলেই সর্বনাশ! কেউ কেউ অবশ্য এই ব্যবস্থায় খুব খুশি। অরুণ-বরুণ দুই ভাইয়ের জমি নিয়ে ঝগড়া, অরুণ রাজসভায় এসে নালিশ করলো, “মহারাজ, আমার ভাই বরুণ বলেছে আমাদের রাজপুত্রের এক চোখ নাকি ট্যারা।“ সেই অভাগা বরুণের রাজপুত্রকে আদৌ চোখে দেখার সৌভাগ্য কোনদিন হয়েছে কি না সেটাই কেউ ঠিকভাবে বলতে পারে না, তবু বরুণের মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়া হলো।

এতদিনে চটকু রাজা আর প্রধানমন্ত্রী দুজনেরই খুব বিশ্বস্ত লোকে পরিণত হয়েছে। টেপ মারা ছাড়াও ছোটোখাটো রাজকার্যে সে সাহায্য করে। মহারাজের বাগানবাড়িতে সে আজকাল নিয়মিত আসা যাওয়া করে। সেবিকা সংগ্রহের জন্য বিশেষ লোক আছে, সেখানে তার প্রয়োজন হয় না। ওই মেয়েদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কাজটি অবশ্য মাঝে মাঝে সে করে দেয়।

চটকুর পদটির কোন পরিবর্তন হলো না। কিন্তু তার কর্মদক্ষতার কারণে আরও কিছু বছর পর দেখা গেলো বখশিশ আর উপরি পাওনা মিলে চটকুর মাসিক আয় প্রায় চারগুণ হয়ে গেছে। রাজসভায় তার খাতির বেড়েছে, কোন কোন মন্ত্রীও তাকে ‘তুই’ এর জায়গায় ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। পাড়ার বিশ-পঁচিশ বয়সের ছেলেপিলেরা তার পেছন পেছন ঘুরে, রাজদরবারে ছোটখাটো চাকরির ব্যবস্থাও আজকাল সে অনায়াসে করতে পারে।

চটকুর ছেলে হাঁটতে পারে এখন, তার বয়স হয়েছে চার। মন্ত্রীমশাইয়ের ছেলে সেদিন ঘোড়ার গাড়ি চালাতে গিয়ে একটা চার বছরের বাচ্চাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে। ঘটনাটা দেখেছে তিন-চারজন। প্রধানমন্ত্রীর হুকুমে তাদের মুখে চটকু নিজ হাতে টেপ মেরে দিয়ে এলো। সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর হওয়ার মন্ত্রীমশাই খুশি হয়ে বেশ ভালো পুরষ্কারই দিলেন। সে টাকায় চটকু ছোট বোন আর বউয়ের জন্য দু’টো করে শাড়ি কিনে নিয়ে গেলো।

শাড়ি পেয়ে সবাই খুব খুশি। তাদের বিধবা মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “এই দিনটা উনি দেখে যেতে পারলেন না। বাবা আমার, এবার তোর বোনটার একটা ব্যবস্থা কর।“

চটকুর দুই বোনের মধ্যে বড়টির বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখন তার অবস্থাও সচ্ছল, ভালো ছেলের সাথেই বোনের বিয়ে দিতে পারবে। পাত্র খোঁজা শুরু হলো, পাওয়াও গেলো একজন। ভালো ছেলে, নিজের ব্যবসা আছে, দেখলে চোখ উল্টে আসে তাও বলা যায় না।

যেদিন মেয়ে দেখতে আসার কথা তার আগেরদিন মহারাজ চটকুকে ডেকে পাঠালেন, “কী রে ব্যাটা, তোরা শরীর স্বাস্থ্য ভালো তো?”

চটকু সালাম ঠুকে বললো, “তা হুজুর আপনার দয়া।“

“লাগছে তো খুশি খুশি। কী ব্যাপার রে?”

“জি হুজুর, আপনাদের সুনজর আছে যেহেতু এখন তো আমার সুখের দিন। বোনের বিয়ে দিচ্ছি, কাল লোক দেখতে আসবে।“

“তাই নাকি? বেশ, বেশ! তোর বোনের বিয়ে ভালো করে দে, টাকা-পয়সা আমি দেবো। তো, একটা কাজ করে দিতে হবে তোর।“

“অবশ্যই হুজুর! বলুন।“

মহারাজ একটু ইতস্তত করে বললেন, “আজ রাতে সেবা-টেবা করার জন্য নতুন একজনকে আনা হবে আর কি। তো প্রধানমন্ত্রী কী খেয়েছে কাল কে জানে, সারাদিন আমাশয়। এখন তদারকির জন্য লোক দরকার একজন। তাই ভাবলাম, তুই আছিস, কাজটা এবার তুই করে দে।“

চটকুর বুক গর্বে আধহাত ফুলে গেলো। এর থেকে সম্মান আর কী হতে পারে? যে কাজ এতদিন প্রধানমন্ত্রী করে এসেছেন সে কাজ করতে যাচ্ছে আজ সে! দিনের বেলায় কত স্বপ্নই যে সে দেখতে শুরু করলো তার কোন হিসেব নেই, আর গদগদ হয়ে উত্তর দিলো, “আপনি কোন চিন্তা করবেন না মহারাজ, সব কাজ আমি সামলে নিচ্ছি।“

সামলে নেয়ার মত কাজ আসলে বেশি নেই। সেবিকা-সংগ্রাহকরা ঘুরে ঘুরে নতুন মেয়ে পছন্দ করে নিয়ে আসে, এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কখনও ভাবেন না, চটকুরও ভাবার কিছু নেই। প্রতিদিন যে নতুন মেয়ে পাওয়া যায় তা না, কেউ কেউ আছে চার-পাঁচবার এ বাড়িতে আসার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। বয়সেরও বিষয় আছে। বাগানবাড়িতে মেয়ে নিয়ে আসার পর সে কোন ঘরে ঢুকবে, কী খাবার দেয়া হবে এসব তদারকির কাজই মূলত তাকে করতে হবে।

সুতরাং সন্ধ্যার দিকে তার সবচেয়ে ভালো পোশাকটি পরে চটকু বাগানবাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। সেবিকা-সংগ্রাহকরা তাকে আগে দেখে থাকলেও পরিচয়টি ঠিক জানে না, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সাথে খাতির দেখে তারা বেশ লম্বা একটা সালামই তাকে করলো। চটকু খুশি হয়েও গলায় গভীর গাম্ভীর্য এনে বললো, “মেয়ে পছন্দ করা আছে?”

“আছে। বলবেন, নিয়ে আসবো।“

“মেয়ের বাড়ির লোকজনকে সব বলা আছে তো?”

“ওসব বলা থাকে না। আমরা রাজার লোক সাহেব। যাই, নিয়ে আসি।“

“বেশ, বেশ। তো শুভকাজে দেরী করতে নেই। তোমরা এখনই যাও।“

আরও একটি সালাম ঠুকে সেবিকা-সংগ্রাহকরা চলে গেলো। তারা আসতে আসতে চটকু ঘুরে ঘুরে সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে কি না তা দেখতে লাগলো। খাবার-দাবার, পানীয় পর্যাপ্ত আছে কি না। মহারাজ যে ঘরে বসবেন সে ঘর পরিষ্কার আছে কি না। বিছানাপত্র ঠিকঠাক আছে কি না, এসব। কোন ফাঁকিবাজির জায়গা নেই।

কিছুক্ষণ পরেই মহারাজ উপস্থিত হলেন, “কী রে, কাজটাজ সব হলো?”

“লোকজন গিয়েছে মহারাজ, এখনই চলে আসবে। আপনি উপরে গিয়ে বিশ্রাম নিন।“

“আহা, দেরী হয়ে গেলো যে। ওরা এলেই উপরে মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিবি, বুঝলি?”

মহারাজ উপরে চলে গেলেন। তার কিছুক্ষণ পরই বাইরে আওয়াজ শুনা গেল। সংগ্রাহকরা ফিরে এসেছে। চটকু হন্তদন্ত হয়ে বাইরে এসে বললো, “এসেছ? কোন সমস্যা হয় নি তো?”

“সমস্যা কীসের হুজুর? সব ঠিকঠাক।“

“ঠিক আছে। মহারাজ উপরে আছেন। নিয়ে যাও।“

মেয়েটি চিৎকার করে কাঁদছে। চটকুর যে একটু কষ্ট লাগছে না তা নয়, কিন্তু এই ঘটনা দেখে দেখে এতদিনে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। রাজার লোকজন টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে লাগলো। চটকুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কী ভেবে যেন মেয়েটি তার দিকে একবার মুখ ফিরে তাকালো। আর ওই চেহারা দেখে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।

মেয়েটি কান্না থামিয়ে দিয়েছে। তার মুখ থেকে কেবল একটি শব্দ বের হলো, “ভাই।“

রাজার লোকজন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। উপস্থিত মানুষদের একজনের মুখ থেকেও একটি কথা বের হলো না। মহারাজ উপর থেকে হাঁক দিলেন, “কী ব্যাপার? কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?”

চটকু শান্ত গলায় উত্তর দিলো, “না মহারাজ, সব ঠিক আছে।“ তারপর সেবিকা-সংগ্রাহকদের দিকে তাকালো, “যাও, নিয়ে যাও। ওকে বাড়ি পাঠানোর সময় হলে আমাকে বলো।“ তারা চলে গেলো। উপর থেকে কান্নার শব্দ আসা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত চটকু একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।

এরপর মহারাজ ভঞ্জাদিত্য দুর্দণ্ডকানুনের বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী তার কাছে গচ্ছিত ডাক্টটেপটি থেকে একটি টুকরো কেটে নিয়ে নিজের মুখে নিজেই লাগিয়ে দিলো।

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: