নিরুদ্দিষ্ট

জানুয়ারী ১৪, ২০১৯ , 0 Comments



মধ্যরাতে কার যেন গলা শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল।

    আমার ঘর তিন তলা বিল্ডিঙটার নিচতলায়। এদিকে মানুষের বসতি কম, কুকুর-বিড়ালেরও অভাব আছে। বারোটার পর পাড়ার সকল শব্দের মৃত্যু ঘটে। তখন এক তলায় একটু জোরে টিভি ছাড়লে তিনতলার ক্লাস এইটে পড়া চুরাশি কেজির বালকটি এসে বলে যায় সাউন্ড কমিয়ে দিতে।

    আমার ঘুমও পাতলা, তাই বাইরে ‘বসন্ত, ও বসন্ত তুই কই?’ ডাকাডাকি শুনে নিদ্রাভঙ্গ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বালিশের পাশে মোবাইল ফোনটা থাকে, সেটা হাতড়ে হাতড়ে খুজে বের করে জ্বালাতেই ডিসপ্লের তীব্র আলো অন্ধকারে আমার সদ্য জাগ্রত চোখদুটোর সাথে জন্ম-জন্মান্তরের শত্রুর মত দুর্ব্যবহার করে নিলো। তার মাঝেই কোনমতে একটাকে খোলা রেখে দেখলাম তখন দুটো সাইত্রিশ। তবে, মধ্যরাতে হাকাহাকি করে বসন্তকে ডাকা হচ্ছে যেখানে সেখানে আমার ঘুম ভাঙার অস্বাভাবিকতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করাই একপ্রকার বিলাসীতা।

    “বসন্ত! তুই কই?”

    এ জায়গায় ভোরে ঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা মানুষদের মাঝে কে আবার হারাবে? কখন ডাকাডাকি বন্ধ হয় তার অপেক্ষায় শুয়ে রইলাম পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনের।

    “ওরে বসন্ত!”

    তখন মাথায় এলো, বসন্ত বাচ্চা ছেলেও হতে পারে। হয়তো সকালে স্কুলে যেতে গিয়ে ফিরে আসে নি। যিনি খুঁজছেন তিনি হয়তো সবখানে খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে এখানে এসেছেন। অনেকক্ষন হয়ে গেল, না বসন্তকে পাওয়া যাচ্ছে, না খোঁজা বন্ধ হচ্ছে তার। যদি এলাকার কেউ না হোন তাহলে অপরিচিত মানুষ কতদূরই বা খুঁজতে পারবেন।

    আমি উঠে দাঁড়াই আর চেয়ারের উপর কোনভাবে ফেলে রাখা শার্টটা তুলে নিই। চাবিটা কোথায় একটু খুঁজতে হয়, সাধারনত টেবিলের উপর যেখানে থাকে সেখানে দেখা যাচ্ছে না। জিন্সের প্যান্টের পকেট ঘাটতে ঘাটতে চাবি পাওয়া যায় শেষপর্যন্ত। মানিব্যাগ নিতে গিয়েও আর নেওয়া হলো না। আমি দরজা খুললাম, মেইনগেটে তালা খুলে লাগিয়ে দিলাম।

    বসন্তকে যিনি খুঁজছেন তার বয়েস পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভেতর। তার বেশভূষা দেখে মনে হয় এইমাত্র অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। তেল আঁচড়ানো চুল, কালো প্যান্টের সাথে জাপটে ইন করা গোলাপী শার্ট। কেবল চোখের উদভ্রান্ত দৃষ্টিটুকুই বেমানান। আবার বেমানান কীভাবে বলি? একমাত্র সে দৃষ্টি ছাড়া অন্য কিছুকেই এ পরিবেশে মানানসই ঠিক বলা চলে না।

    “আপনি খুঁজছেন কাউকে?” আমি জিজ্ঞেস করি তাকে। আমার দিকে না তাকিয়ে ঝোপে-ঝাড়ে উঁকি মারতে মারতে তিনি উত্তর দেন, “বসন্তকে।“

    “আপনি এদিকে থাকেন না কি?”

    “উহু।“

    “বসন্ত কি এদিকে হারিয়েছে?”

    মানুষটি আমার চোখের দিকে তালালেন এবার, “বসন্ত কোথায় হারিয়েছে তা তো বলতে পারি না।“

    ঠিক কেন আকাশের চাঁদের দিকে আমি তাকালাম বলতে পারি না। চাঁদ তখন গোল কাস্তের মত ঝুলে আছে। নাহ, ঝুলে তো নেই, চাঁদ ঘুরছে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে তা বুঝার উপায় নেই। বসন্ত কোথায় হারালো তাও বুঝার উপায় নেই। নয়তো এ শরতের মধ্যরাতে কেরানি চেহারার একজন মানুষ কি বসন্তকে খুঁজতে বের হয়?

    “বসন্তের বয়স কত?”

    “বয়স? এই তো, আমার সমানই হবে।“

    “বলেন কি! এত বড় লোক হারিয়ে গেছে? কীভাবে?”

    “মানুষের ভীরে। বসন্তরে, কই গেলি তুই?”

    বসন্ত কোথায় গেল কে জানে? আমার বালিশে মাথা পাতার প্রবৃত্তিটুকু কমতে শুরু করেছে তখন। এত বড় মানুষ হারিয়ে গেল, গল্পটার শেষ দেখা উচিৎ। কে জানে গল্পের শেষে কোন মানুষের কলসিতে ভরে মাটির নিচে চাপা দেওয়া কোন গোপন কথা উদঘাটিত হবে। বিছানার পায়ার সাথে শেকলে বেঁধে যাদের ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয় তাদের দেখাও হয়তো মিলবে। আমি কল্পণায় দেখি বসন্তকে খুঁজে বের করে কত কত মানুষের কৃতজ্ঞ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আমি বিনয়ী হয়ে বলছি, ও কিছু না।

    “বসন্ত আপনার ভাই বা বন্ধু হয় কি?”

    “খুব কাছের কেউ হয়।“

    “ও। আপনাকে সাহায্য করি, চলুন।“

    তারপর দুজন মানুষ মিলে আমরা বসন্তকে খুঁজতে শুরু করলাম। টং দোকানের ধ্বংসাবশেষে তাকে পাওয়া গেল না, কিংবা নতুন গড়া দালানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপ ভ্যানের পিছনে। ফুটপাথে বসন্ত ঘুমায়নি, যাদের ঘুমোতে দেখলাম তাদের হারিয়ে যাওয়ার খোঁজ কেউ সম্ভবত করবে না। কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে চোখ কচলাতে কচলাতে আসা বৃদ্ধের ঘরে বসন্ত নেই। এতরাতে ডাক দেওয়ায় রেগে যাওয়া কর বিভাগের চিকন গোঁফ আর সোনালী ফ্রেমের চশমার এম.এল.এম.এস.টিও বসন্তের খোঁজ জানে না। কিংবা স্টেশনারি দোকানের মধ্যবয়স্ক মালিকটির সোফাতেও ‘কেবল আজ রাতের জন্য’ বসন্ত ঘুমিয়ে নেই। তবু তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “পুলিশ-হাসপাতাল দেখছুইন নি?”

    “দেখেছেন?” আমিও প্রশ্ন করি। কেরানিমতন মানুষটি বলে, “দেখেছি, নেই সেখানে।“

    আমরা খুঁজে গেলাম। খুঁজতে খুঁজতে পাঁচটা বেজে গেল, তবু বসন্তকে পাওয়া গেল না। আর পাওয়া যাবেও না। কিছু কিছু বেয়াদব পাখি এখনই ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। আমার ঘরে ফেরার সময় হয়ে এলো।

    “আজ আর হবে না। চলুন ফিরে যাই।“

    মানুষটি বিষণ্ণ হাসি হাসলেন আর আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন, “আসলে বসন্তকে আপনারা কেউ খুঁজে বের করতে পারবেন না। পারলে আমিই পারব, আমাকেই পারতে হবে।“

    “আচ্ছা, বসন্ত দেখতে কেমন বলুন তো। আমি চোখ কান খোলা রাখব। আপনার ফোন নাম্বারটি দিয়ে যান, বসন্তকে পেলে জানাব।“

    “দেখতে? ওই অনেকটা আমার মতোই দেখতে। কিন্তু আপনি তো তাকে খুঁজে পাবেন না। বললাম না? আমি পাব পেলে।“

    “আপনি আপনার নাম্বারটা তবু রেখে যান।“

    মানুষটি চাপাচাপিতে আমার ফোনটি হাতে নিয়ে তাতে নিজের ফোন নাম্বার আর নামটি লিখে দিলেন। এতটুকু করে আর কথা বাড়ানোর সময় (বা ইচ্ছা) হলো না তার, আমাকে এভাবেই রেখে তিনি অন্যদিকে পা বাড়ালেন। আমার ধারনা অন্য পাড়া, অন্য কারও বাড়ির সামনে তিনি আবার বসন্তকে খুঁজবেন।

    কে জানে কেন তার ধারনা আর কারও বসন্তকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতা নেই। এ কথার কোন মানে হয়? তবুও ফোনে তার যোগাযোগের নাম্বারটির উপর লেখা নামটুকু দেখতে গিয়ে আমি বুঝে গেলাম (কিংবা হয়তো বুঝিনি) যে মানে সত্যিই হয়।

    কারন বড় হাতের অক্ষরে লেখা নিজের যে নামটি তিনি দিয়ে গেলেন আমায় তা যে ঐ BASANTA.

 The picture used as the cover was digitally painted 

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: