অভয়

মার্চ ১২, ২০১৯ , 0 Comments


 মূল গল্পের অবতারণার আগে আমরা জনৈক ল-স্টুডেন্টের সাথে পাঠকগণের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।

    আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন জনৈক ল-স্টুডেন্টের প্রয়োজনটা কোথায়? এ যে চরিত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে গল্পের আকার বড় করার ফন্দিই কেবল – সেরকম অভিযোগও আদালতে ভুল প্রমাণ করার জন্য পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ আমার হাতে নেই। তবে কি না, তার আগমনে মূল কাহিনীর কোন ক্ষতি হবে না। গল্প যা বলার ছিল আমরা তাই বলবো, ল-স্টুডেন্ট না থাকলে যেভাবে বলতাম ঠিক সেভাবেই। সুতরাং এ অন্যায় সংযোজনাটি ক্ষমা করাই যায়।

    যেহেতু তার গুরুত্ব নেই তাই জনৈক ল-স্টুডেন্টের চুল খাটো না লম্বা, মুখ চারকোনা নাকি গোলগাল, তিনি রুই মাছ খেতে বেশি ভালোবাসেন নাকি পাঙ্গাশ তা জানার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা এটুকু বলতে পারি যে তিনি পরীক্ষার হলে বসে গভীরভাবে একটি প্রশ্নের উত্তর চিন্তা করছেন।

    এবার অন্য কোথাও কী হচ্ছে দেখা যাক।

    রাস্তার ধারের ছোট দ্বীপের মত পার্কটিতে রেখা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে বসে আছে। এ সকালে এখানে মানুষজন কম। কলেজের সাদা শার্ট আর নীল প্যান্ট পরা একদল ক্লাস পালানো ছেলে এক কোনায় সামান্য জায়গা পেয়ে ব্যাট দিয়ে বল ঠুকার খেলা জুড়ে দিয়েছে। দূরের বেঞ্চে ঠায় বসে থাকা বুড়োর সম্ভবত আধফুট লম্বা দাঁড়িতে সামান্য রোদ লাগানো ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আজ ছুটির দিন নয়। এসময় বাচ্চারা স্কুলে যায়, অবাচ্চারা অফিস করে। কেউ প্রেম করতে আসে না, এ দেশে সকালবেলা প্রেম করার বিলাসিতা ক’জনের আছে? হাওয়াই মিঠাইওলা কোন ফাঁকে কী ভেবে ঢুকেছিল, দুটো বড় বড় মিঠাই বিক্রি করে সে এখন গাছতলায় চোখ বন্ধ করে বসে ঢুলছে।

    দ্বিতীয় হাওয়াই মিঠাইটি যার হাতে তিনি রেখার অতি দুঃসম্পর্কের চাচা। নিরীহ চেহারার মানুষ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো তেল-মাখা চুলে সূর্যের আলোর প্রতিফলন করাতে করাতে তিনি ঝকঝকে সাদা দাঁত দিয়ে হাতের বস্তুটিতে কামড় বসাচ্ছেন। চাচার হাওয়াই মিঠাই অর্ধেক শেষ, রেখার হাওয়াই মিঠাই বাতাসে জমতে জমতে ছোট হয়ে যায়।

    "রেখা, খাচ্ছ না কেন?”

    "খাচ্ছি তো।"

    রেখার হাওয়াই মিঠাই এ আর একটি কামড় পড়ে, দ্বিতীয় কামড় পড়তে পড়তে তার চাচার হাতেরটি ফুরিয়ে যায়। তিনদিন আগে চুরি করে চকলেট খাওয়ার জন্য রেখাকে ওর মা বকে বকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। তার কিছুদিন আগে চিনি খেতে গিয়ে একটি বড়সড় কাঁচের বয়ামের অকাল মৃত্যু ঘটেছে তার হাতে। গোলগাল নকশা করা সুন্দর বয়ামটি টুকরো টুকরো করে রেখার সে কী কান্না! তাকে শান্ত করতে বিকেলে বাবা বাড়ির নিচে আগাছার জঙ্গলের মাটি খুড়ে বয়ামের টুকরোগুলোকে সম্মানের সাথে দাফন করে দিলেন। রেখা তার বন্ধু জিনিয়ার বাড়ি থেকে বড় একটা পাতাবাহারের পাতা এনে কবরের উপর লাগিয়ে দিয়েছে।

    সুতরাং ভালো লাগে না বলে হাওয়াই মিঠাই রেখা খাচ্ছেনা এ অভিযোগ করা যাবে না। সকালে ভরপেট খেয়ে পেটে তার বিন্দুমাত্র জায়গা যে ফাঁকা নেই – সে ভাবনাও ভিত্তিহীন। কারণ আজ কতটুকুই বা খাওয়া হয়েছে তার? রেখার বাবা-মা কেউ বাড়ি নেই, রুহু চাচ্চুর সাথে আজ সে একা। এমনিতে তারা রেখাকে ফেলে বাইরে কোথাও যান না। কিন্তু এবার নাকি তাদের গ্রামের বাড়িতে ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা ঘটেছে। রেখার বাবা কয়েকবার ‘অপ্রীতিকর’ আর ‘নির্লজ্জ’ শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন। রেখার মা কয়েকবার ‘স্ক্যান্ডালাস’ আর ‘মোরাললেস’ শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন। যে ঘটনার বর্ণনা করতে এত কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করা লাগে সেখানে রেখার মত এগারো বছরের বাচ্চাদের যাওয়া নিষেধ। তাই রুহুর কাছে রেখাকে জমা রেখে তার বাবা-মা গতকাল পটুয়াখালী চলে গেলেন।

    রুহু চাচ্চুর সাথে রেখার এর আগে খুব ভালো পরিচয় ছিল তেমন নয়। তার বয়স সাতাশ-আটাশ হবে, মাঝে মাঝে তাদের বাসায় এসে চা-বিস্কুট খাওয়া ছাড়া রুহু চাচ্চুকে আর কখনও কিছু করতে দেখা যায় নি। তিনি চুপচাপ শান্তশিষ্ট মানুষ, আর রেখা হাত দিয়ে টিকটিকি ধরে দুইতলার বাবুর মাথায় ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু কাল রাতে একটা ঘটনা ঘটেছে, সে ঘটনার পর রেখা একটু ভয়ে ভয়ে আছে। ভয়ে থাকলে মানুষের গলা দিয়ে যেমন ভাত নামে না তেমন রেখার গলা দিয়ে হাওয়াই মিঠাই নামছে না।

    "রেখা, মা, তুমি কি খাবে না?”

    "খাবো। এই যে, খাচ্ছি।"

    "তুমি কি কালকের রাতের ঘটনা নিয়ে ভয় পাচ্ছ?”

    রেখা কোন উত্তর দেয় না, তার চোখের কোনায় পানি চিকচিক করে উঠে। রুহু চাচ্চু হাত দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলেন, "আহারে, ভয় পেয়ো না। এটা কোন বিষয় না, এরকম হয়। কত মানুষের হয় তার কোন হিসেব আছে? কিচ্ছু চিন্তা করার নেই।"

    রেখা এবার বড় বড় চোখে তাকায়, "অনেক মানুষের হয়? ঠিক বলছ?”

    "হ্যাঁ!”

    হাওয়াই মিঠাই শেষ হয়। রেখার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে স্কুল ফাঁকি দিতে। প্রতিদিন স্কুলে যেতে কার ভালো লাগে? মা তো ফাঁকি দিতে দেবে না, কিন্তু রুহু চাচ্চু দেয়। সে বলে একদিন স্কুলে না গেলে কিছু হয় না, একদিন বাইরে বেড়াতে হয়। তবে আজকের ছুটিটা রেখার এতটাও ভালো লাগছে না কেন যেন। টুসিদের বাসার সবাই মিলে থাইল্যান্ড ঘুরতে গেলো গত সপ্তাহে। টুসি বলে দিয়েছে রেখার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসবে ওখান থেকে। তারা কবে ফিরবে কে জানে, হয়তো টুসি আজকেই ক্লাসে যাবে। আজ সেখানে না থাকার কারণে তার জন্য আনা জিনিসগুলো একে একে ক্লাসের সবাই ভাগাভাগি করে নিয়ে নিচ্ছে সে কল্পনা করে রেখার চোখে প্রায় জল এসে গেল।

    ধকল যাবে আজ পার্কের পাশের কনস্ট্রাকশন সাইটের শ্রমিকদের, যা রোদ পড়েছে। রক্ত পানি করে খেঁটে তাদের কেউ অবশ্য শপিং-মলে টেডি বিয়ার কিনতে যাবে না। ষড়যন্ত্র করে বেড়ায় ঘাম সারাজীবন অর্থ-বিত্তের সাথে। নইলে এয়ার-কন্ডিশনার লাগানো পুতুলের দোকানে শ্রমিকরা যেতে ভয় পাবে কেন?

    পুতুল একটা রেখার পছন্দ হয়েছে অবশ্য। সোনালি চুলের পুতুলটি দাঁত বের করে হাসছে, যেন লাল স্কার্টটি পরে কতই খুশি সে। রুহু চাচ্চু চাকরি-বাকরি কী করেন কে জানে, তিনি টাকা বের করে দেন। তবে তার মুখ দেখে যথেষ্ট সন্তুষ্ট তিনি হয়েছেন তা বলা যাবে না। আসলে, এত বড় পুতুল এর আগে কখনও তার কেনা হয়নি।

    "পছন্দ হয়েছে?”

    "হ্যাঁ।"

    রেখার ফ্রাইড রাইস ভালো লাগে, সাথে লালচে কালো কোক। দুপুরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে তারা তাই খেলো। বাড়িতে ফ্রিজে খাবার রাখা আছে, কিন্তু রুহু চাচ্চু বললেন মাঝে মাঝে বাইরে খেলে কিছু হয় না। আর কেবল ফ্রাইড রাইস চেটেপুটে খেয়ে কি কেউ ফিরে যায় নাকি? তারপর আইসক্রিম আসে। বড় কোন আইসক্রিমটি হাতে পেয়ে রেখার মন অনেক ভালো হয়ে যায়।

    "রেখা, তুমি কি এখনও কালকের ঘটনা নিয়ে ভয় পাচ্ছ?”

    রেখা কোন উত্তর দেয় না। রুহু চাচ্চু তার মাথায় হাত রেখে বলেন, "ভয় পেয়ো না। আমরা ঘটনাটা তোমার বাবা-মা কে বলবো না, কেমন? তাহলেই তো হয়ে গেল। এ আমাদের সিক্রেট, কেমন?”

    আইসক্রিম খেতে খেতে রেখার মুখ খুলতে ইচ্ছে হয় না। সে কেবল তার মাথাটা একপাশে নামায়। মাথা ওভাবে একপাশে নামালে আমরা বুঝে নিতে পারি ইঙ্গিতটির অর্থ ‘হ্যাঁ’।

    "তুমি হাঁটতে পারছ ঠিকমত, না কি কোলে করে নিয়ে যাবো?”

    "হাঁটতে পারবো।"

    উচ্ছ্বাসহীন গল্পেও কিছু রহস্য থাকে, যেমন গতকাল ঠিক কী হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারবো না। তবে এটা বলতে পারি যে, জনৈক ল-স্টুডেন্টের পরীক্ষার প্রশ্নে যা হয়েছিল তার শাস্তি কী যদি জিজ্ঞেস করা হতো তবে (একটু ঘৃণাভরেই) তিনি হয়তো খাতায় লিখতেন ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’।

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: