তবু আমরা বড়ো ভালো আছি

অক্টোবর ২১, ২০১৯ , , 0 Comments


কিছুদিন আগে একটা ডেইরি ফার্ম থেকে কিছু শুকনো খড় আনতে গিয়েছিলাম আগুন জ্বালানোর জন্য, আসার সময় এক বোতল ঘি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কেদার বললো সস্তায় পাওয়া গেছে। এখন কিছু সেগুন কাঠের টুকরো জ্বালিয়ে কয়েক মিনিট পর পর তাতে ঘি ঢেলে দেখছি কী হয়।

আগুনে ঘি পড়লে তা ছ্যাঁত করে বদরাগী মানুষদের মত জ্বলে উঠে, এই ছ্যাঁত শব্দটা বেশ ভালোই লাগছে আমার। তবে ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে, চশমা পরা বলে বেঁচে গেছি। এ ঘর থেকে ধোঁয়া সহজে বের হতে পারে না। কোন জানালা নেই, ছাদ এর কাছে নকশা করা ভেন্টিলেটরগুলো আছে বলে রাত না দিন তা বুঝা যায়। লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ বিল কমানোর জন্য। সত্যি বলতে কি, আমাদের বাজেটে কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু অতিরিক্ত খরচ আমি পছন্দ করি না।

আগুনের হলদে আলোতেই যা দেখার তা দেখা যাচ্ছে। মেঝেতে রাখা বোতলগুলোতে এখনও কিছুটা লাল তরল টিকে আছে। তাদের পাশে একটি কাগজের ঠোঙা। হাতলভাঙা রিভলভিং চেয়ারটি কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে কেবল, মানুষ হলে নিশ্চয়ই সেটি এতদিনে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নেমে যেত। মাথা হেলান দেয়ার জায়গাটা ছত্রাক জন্মে নষ্ট হয়ে গেছে। খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে কেউ এখানে বসতে চাইবে না। এই ঘরটা যখন কিনেছিলাম রিভলভিং চেয়ারটা তখন থেকেই ছিলো, আমিও অকেজো জিনিসটা ফেলতে পারিনি। তার পাশে একটা কাঠের চেয়ারের  উপর কমলা রঙের একটা নাইলনের দড়ি পেঁচিয়ে রাখা। রিভলভিং চেয়ারটায় আমি মাঝে মাঝে বসি, আপাতত অর্গানাইজেশন ম্যানেজমেন্টের উপর একটা বই সেখানে রাখা আছে। দেড় সপ্তাহ ধরে পড়ে বইটা আমি প্রায় শেষ করে এনেছি।

একেবারে কোনায় কাঠের লাকড়ি বড় একটা স্তূপ। সেখান থেকে কিছু নিয়ে ছোট অগ্নিকুণ্ডটি তৈরি করেছি আমি। কিছুক্ষণ পর বড় অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হবে। এসময় কিছুটা কষ্ট হয় আমার, যখন বড় আগুনের পাশে দাঁড়াতে হয় তখনের কথা বলছি। এই বদ্ধঘরে আলো-বাতাস আসতে পারে না ঠিকমত, তার সাথে আগুনের তাপ মেশে। চশমা পরেও চোখকে তখন পুরোপুরি বাঁচানো যায় না, আর ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসা তো আছেই। অক্সিজেন মাস্কের ব্যবস্থা করবো কি না ভাবছি। এই প্রজেক্টের পেছনে কম টাকা তো ঢালা হচ্ছে না, এফিসিয়েন্সি বাড়ানোর জন্য একটু ইনভেস্ট করা যেতেই পারে। তাছাড়া, কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্যের দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। যদিও আমি আর কেদার ছাড়া আর কেউ কাজটির সাথে যুক্ত নয় তবু হিপোক্রেসির থেকেও প্রফেশনালিজম শক্তিশালী শব্দ।

প্রজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা প্রয়োজন মনে হচ্ছে। দাপ্তরিক নামটি যদিও প্রকল্প নরমেধ আমি ছোট করে বলি নূরু। আমাদের কাজ বড় অগ্নিকুণ্ডে মানুষ নিক্ষেপ করা। জ্যান্ত মানুষ, ঐ সতীদাহের মত ব্যাপারস্যাপার। যাকে তাকে অবশ্য নয়, আমরা আপাতত কাজ করছি কেবল সুখী মানুষদের নিয়ে। ফিল্ড ওয়ার্কগুলো করে কেদার। শহরের পথে চলতে চলতে যাদের সুখী মানুষ বলে মনে হয় তাদের ধরে আনা হয় এখানে। রাস্তা থেকে সরাসরি মানুষ তুলে আনা অবশ্য সম্ভব নয়, আমাদের ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হয় টার্গেট কোন নির্জন স্থানে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর কেমন করে মানুষটিকে কব্জা করা হবে, বাঁধা হবে, গাড়িতে ওঠানো হবে তার সবটুকু নির্ভর করে কেদারের উপর। কেদারের ফিডব্যাক চেয়েছিলাম কিছুদিন আগে, সে বললো কাজ করে নাকি তার ভালোই লাগছে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে সে কাজের আনন্দটাই গায়েব হয়ে যায়।

যা বলছিলাম তাতে ফিরে আসি। কব্জা করে টার্গেটকে নিয়ে আসা হয় এখানে। মানুষ হাতের কাছে আসার পরই আমরা বড় অগ্নিকুণ্ড তৈরি করার কাজটুকু শুরু করি, টাইমিং ঠিক না রাখলে অযথা জ্বালানী নষ্ট হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ আগুন তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত হবু-মৃতের সাথে আমি কিছু কথাবার্তা বলি কেবল সময় কাটানোর জন্য, অন্য কিছু নয়। অধিকাংশ সময় কোন গভীর আলোচনায় যাওয়াই সম্ভব হয় না, কেঁদেকেটেই বাঁচে না লোকজন। কিন্তু কিছু করার নেই, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ভিকটিমরা ছাড়া ঘরে আর মানুষ থাকে কেদার। কেদারের সাথে কথোপকথন আর একটা কেদারার সাথে কথোপকথনে তেমন কোন পার্থক্য আমি খুঁজে পাই না।

তবে একজনকে পেয়েছিলাম যার সাথে কথা বলে ভালো লেগেছিলো। ভুল করে একবার কেদার সুখী মানুষ এর জায়গায় একজন নিহিলিস্টকে ধরে নিয়ে এসেছিলো। কতই বা হবে মেয়েটির বয়স, সাতাশ-আটাশ? কোন জীবন দর্শনের ট্যাগ তো তার গায়ে লাগানো ছিলোনা, কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুর অসারতা বুঝার জন্য ওর চোখের দিকে একবার তাকানোই যথেষ্ট মনে হয়েছিলো আমার কাছে। পরিচয়ের কোন প্রয়োজন পড়ে নি।

নাহ, নিহিলিস্ট বলাটা ঠিক হচ্ছে না। তারা বিশ্বাস করে জীবনের কোন অর্থ নেই। আসলে, সে ভয়াবহ শূন্যতাকে প্রকাশ করার জন্য সত্যিই কোন শব্দ আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু ওই মেয়েটির দিকে যতবার তাকিয়েছি আমি ততবার মনে হলো জীবনের অর্থ আছে কি নেই সে নিয়ে চিন্তা করাও গণ্ডমূর্খের কাজ। অর্থের কোন অর্থ নেই, মানের কোন মানে নেই। ছায়াপথের চেয়েও বড় এক নির্লিপ্ততা এই বর্গাকৃতির বদ্ধ-ঘরটিতে জায়গা নিয়ে যেন আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য গ্রাস করলো।

মেয়েটির চোখ বাঁধা ছিলো, আমি দাড়িয়ে ছিলাম তার ঠিক সামনে। বাঁধন খুলে দেওয়ার পর সে আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো, আমি একটিবার তার চোখের মণি নড়তে দেখি নি। কতক্ষণ এ করেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম আমি জানিনা, একসময় মনোটোনাস স্বরে সে জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে ধরে এনেছ কেন? মুক্তিপণ চাইবে? নাকি রেপ করবে?”

“না, না, ছি ছি। রেপ করবো কেন? সোজাসুজিই বলি, আপনাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। সেটাকে ঠিক খুন বলতে চাই না, কারণ ঝলসে যাওয়ার পর আমাদের দায়িত্ব শেষ, আপনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তা আমরা দেখতে যাবো না। আমাদের কাজ শুধু হাত-পা বেঁধে আপনাকে আগুনে ছুঁড়ে মারা।“

“কেন?”

“আমাদের কোন বড় উদ্দেশ্য নেই। ইচ্ছে হয় তাই সুখী মানুষদের ধরে ধরে আগুনে ছুড়ে মারি। বেকার থাকার চেয়ে কিছু একটা তো করা ভালো, তাই না?“

মেয়েটি হতাশ হলো যেন, “যা ভেবেছিলাম, আমার কেন’র উত্তর তুমি দিতে পারবে না। তোমার কাছেও কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু আর সবার মত তুমিও আমার প্রশ্নটি বুঝতে পারো নি।“

“প্রশ্ন বুঝতে পারি নি?” আমি লজ্জা পেলাম, “একটু বুঝিয়ে বলুন তো।“

“বুঝিয়ে কেমন করে বলি? একটা গল্প বলি তবে। রাজা অমরশক্তির তিন মূর্খ পুত্রকে বিষ্ণুশর্মা গল্প বলে শিক্ষা দিতেন। আমি গল্পটা বলি, তুমি বুঝতে পারলে বুঝে নিও।“ এ কথা বলে মেয়েটি গল্প শুরু করলো। আমি আর কেদার হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে গেলাম।

একবার হরিণ, বুনো শুয়োর, বাঘ আর অজগর মিলে ঠিক করলো জঙ্গলে বিপ্লব ঘটানোর। বনের রাজা সিংহকে সিংহাসনচ্যুত করতে হবে। বুনো শুয়োর বললো, “প্রথমে আমি ধাক্কা মেরে সিংহকে দুহাত দূরে ছুড়ে ফেলে দেবো।“ অজগর বললো, “ঠিক তখনই আমি ব্যাটাকে এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরবো যে সব নড়ন-চরণ বন্ধ হয়ে যাবে।“ হরিণ বললো, “তারপর সিংহের পেটে শিং ঢোকালেই পাকস্থলীর বারোটা বেজে যাবে।“ বাঘ বললো, “বাকিটা আমি দেখছি, কোন চিন্তা নেই।“

উপরে বসে ছিলো বানর, ওদের কথা শুনে সে আর হাসি থামাতেই পারে না। তার দিকে চোখ পাকিয়ে অন্য জন্তুরা প্রশ্ন করলো, “হাসছিস যে? এখানে হাসির কী আছে?” বানর হাসতে হাসতে জবাব দিলো, “সুন্দরবনে সিংহ আসবে কোথা থেকে?” বানরের কথা শুনে হরিণ, বুনো শুয়োর, বাঘ আর অজগরের খেয়াল হলো তাই তো, সুন্দরবনে তো সিংহ নেই। তাহলে সিংহাসনচ্যুত করবে কাকে? তখন তারা আর কী করবে, চারজন হতাশ হয়ে গাছের নিচেই বসে রইলো।

এসময় কোথা থেকে একটা বড় সিংহ এসে চারজনকে গপ করে গিলো ফেললো।

আমার সহযোগী কেদারের মন ছিলো অনেকটা শিশুর মতন। বাচ্চারা নিষ্ঠুরতা বুঝতে পারে না বলে না জেনেই কখনো কখনো নিষ্ঠুর হয়ে উঠে। কেদারও ছিলো তেমন। নতুন রাস্তা দিয়ে চলার সময় সে ল্যাম্পপোস্টের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো, পাগল দেখলে ধাওয়া করে বেড়াত। বেড়াল কী করে কেবল তাই দেখার জন্য একবার সে ওটাকে ছাঁদ থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে পানি ভরা বালতিতে ডুবিয়ে রেখেছিলো। জানোয়ারটি পানিতে যখন ছটফট করতে শুরু করলো তখন কেদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি নৃশংস আনন্দ বা পাশবিক উল্লাসের মত কিচ্ছু দেখতে পাই নি। ওখানে কেবল ছিলো নিষ্পাপ কৌতূহল। বাচ্চাদের মতই কেদারও গল্প শুনতে ভালোবাসে। সুতরাং এই গল্পটি শুনে ওর কাঁদো কাঁদো হয়ে যাওয়া মুখ দেখে আমি একটুও অবাক হইনি, “এটা কোন গল্প হলো?”

আমি মেয়েটিকে বললাম, “সত্যিই তো। এ গল্পের কোন আগা-মাথা নেই। আপনাকে বলেছিলাম বুঝিয়ে বলতে, এ গল্প শোনার পর যেটুকু বুঝেছিলাম সেটাও এলোমেলো হয়ে গেছে। যে বনে সিংহ নেই সেই বনের জন্তুরা সিংহকে মারতে চাইবে কেন? আর সবার শেষে একটা সিংহ আবার কোথা থেকে চলে এলো? আর চারটে এত বড় বড় জন্তুকে এভাবে গিলে ফেলাও সম্ভব নয়।”

“তুমি এ কথাগুলো বলছ তারমানে তুমি এবারও বুঝতে পারো নি।“

“যার মানে নেই তা আমরা কেমন করে বুঝবো?”

“আমি তো মানে বুঝতে বলিনি, আমি কেবল বুঝতে বলেছি।“

আমরা মেয়েটিকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছিলাম নাইলনের দড়ি দিয়ে। এমনভাবেই বাঁধা হয়েছে যেন চামড়ায় দড়ি গেঁথে যায়। যতই চেষ্টা করুক সে নড়তে পারতো না। তার চিৎকারও সহজে বাইরে যাবে না, ঘরটি সেভাবেই বানানো। কেউ বাঁচাতে আসবে না। অগ্নিকুণ্ড তখন প্রায় তৈরি হয়ে গেছে, আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। আমরা দুজন এভাবেই বেঁধে মেয়েটিকে আগুনে ছুড়ে মারতাম। তার চিৎকার যদিও আমাদের সহ্য হবে না তবু আমরা আগুনের সামনেই দাড়িয়ে থাকতাম।

কিন্তু এই মানুষটির সামনে বসে আমার মনে হলো পৃথিবীতে আজ আমার থেকে অসহায় কেউ নেই। আমি যা অনুভব করেছিলাম তখন তা ঠিক ভয় নয়, একধরনের ক্ষুদ্রতা। আমার মনে হতে লাগলো দুনিয়ার সবকিছুতেই কোথাও একটু ভুল হয়েছে, একটা অণু-পরমাণুও সে ভুল থেকে বাঁচতে পারে নি। হঠাৎ করে কী হলো জানি না, আমি বললাম, “আপনাকে পোড়াবো না, আপনি চলে যান।“

“কেন পোড়াবে না বল তো?”

আমার মুখ থেকে বের হলো, “আমরা যে ধরনের মানুষকে পোড়াই আপনি সে ধরনের মানুষ নন। আমরা সুখী মানুষদের নিয়ে কাজ করি, আপনি সুখী মানুষ নন। কেদার একটা ভুল করে ফেলেছে। আপনি চলে যান।“

আমার মন বলছিলো, “আমি বাস্তবতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে গেছি। আমি আপনার শূন্যতার মাঝে আটকে গেছি। শূন্যতার কাছে ধ্বংস বলতে কিছু নেই।“

ওইদিন এরপর কী হলো তা আমার ভালো করে মনে নেই। কেদার বাঁধন খুলতে খুলতে একটা প্রশ্ন করেছিলো, সেটা আবছা আবছা মনে করতে পারি, “স্যার, ছেড়ে দিচ্ছেন। যদি পুলিশকে বলে দেয়?” আমার যতটুকু মনে পড়ে বলেছিলাম, “পুলিশ জানবে না। খুলে দে।“ তারপর মেয়েটি কী করলো কোথায় গেলো আমি বলতে পারি না। এর পরের সপ্তাহ আমরা সতর্ক ছিলাম, কিন্তু পুলিশ সত্যিই জানেনি। এ মানুষটির কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কিন্তু আমার ধারনা একটা সময় আসবে যখন আমরা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো না এ ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিলো নাকি আমি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।

পরে যখন কেদারকে জিজ্ঞেস করলাম সুখী মানুষ ধরে না এনে এই মেয়েটিকে কেন সে ধরে আনলো তখন সে জবাব দিলো প্রথমবার একে দেখে তার সুখী মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল। শহরে আমাদের একটি বড় বাড়ি আছে। বাড়িটি এতটাই বড় যে অসংখ্য মানুষের এই শহরে সেটাকে অনেকের জায়গার অপচয় বলে মনে হতে পারে। কেদার সে বাড়িতেই একটি ছোট ঘরে থাকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে সেদিন কেদার ঠিক সামনেই মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো। ক্লান্ত, ভাবলেশহীন মুখটিতে কোন সন্তুষ্টি, কোন সুখ কেদার দেখেছিলো সে প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও চিন্তা করে বের করতে পারিনি।

ঘরের লোহার দরজায় টোকা পড়লো। চারবার টোকা দিয়ে কিছুক্ষণ বিরতি, তারপর তিনটি টোকা, তারপর আবার চারটে। এই টোকার অর্থ কেদার এসেছে এবং তার সাথে কেউ আছে। কেবল চারটে টোকার মানে সে একা। আশেপাশে হঠাৎ করে কারও কেদারকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা নেই, যদি দেখেও ফেলে তবু তেমন সমস্যা হবে না। আমরা অনেকদিন ধরে এ এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি, লোকজন পরিচিত হয়ে গেছে। তারা আমাদের ঘাটায় না। কিন্তু কখন নতুন মানুষজন চলে আসে কে জানে। মুখবন্ধ করার জন্য কিছু একটা করতেই হবে তখন, আর তাতে ফোকাস চলে যাবে অন্য দিকে। আমি সেটা একেবারেই চাই না। তাড়াতাড়ি গিয়ে আমি দরজা খুলে দু’জনকে ভেতরে নিয়ে এলাম।

কেদার ধরে এনেছে একজন ছোটখাটো মধ্যবয়স্ক মানুষকে। গায়ে পাঞ্জাবি, মেহেদি করা চুল-দাঁড়ি। আগেই বলেছি, টার্গেটদের কেমন করে কব্জা করা হয় তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম আমাদের নেই। কেদার যা ভালো বুঝে তাই করে। কখনও কখনও সারা শরীর বেঁধে মুখে টেপ লাগিয়ে রাখা হয়, তখন আমরা দুজন ধরাধরি করে গাড়ি থেকে মানুষটাকে নিয়ে আসি। মাঝে মাঝে কেমিক্যাল দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলা হয় ভিকটিমদের। জ্ঞান ফেরাতে অনেক সময় লাগে, তাই সেসব দিনগুলোতে জ্ঞানহীন দেহগুলোকেই আগুনে ছুড়ে মারতে হয়। সে দিনগুলি আমার খুব খারাপ যায়, কথা বলার কোন সুযোগ থাকে না। যখন চামড়া পুড়তে থাকে তখন অবশ্য সবারই চেতনা ফিরে আসে, কিন্তু এ মুহূর্তে তো আর তাদের সাথে আলোচনা করা যাবে না।

কেদারের হাতে বড়সড় একটা ছুড়ি চকচক করছে। তার ভয়ে মানুষটি নিজে নিজেই ঘরে ঢুকলো। লোকটি একবার পেছনে তাকালো, মনে হয় ছুড়িটা এখনও কেদারের হাতে আছে কি না দেখার জন্য। “কোন সমস্যা হয় নি তো?“ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না স্যার। আঙ্কেল ভালো লোক, কথা শুনেন। আমি শুধু বলেছি আমি না বলা পর্যন্ত মুখ থেকে একটা কথা বের হলে এই জিনিসটা দুই পায়ের মাঝখানে বসিয়ে দেবো। এতেই কাজ হয়েছে, এখন পর্যন্ত একটা শব্দও আঙ্কেল করেননি। গাড়িতে জগজিৎ সিং এর গান বাজাচ্ছিলাম, সে গান শুনলে যে কেউ একবার আহা-উহু করবেই। আঙ্কেল কিছুই করেননি। ভালো লোক, খুবই ভালো লোক স্যার।“

“অস্ত্রটা কত দিয়ে কিনলে? ভালো স্টিল মনে হচ্ছে।“

আমার কথায় কেদার একটু লজ্জা পেলো, “আসলে কিনিনাই স্যার। খালাম্মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছি।“

“মা কিছু জিজ্ঞেস করেছে?”

“নাহ। চাইতেই দিয়ে দিলো।“

আমরা আঙ্কেলকে চেয়ারে বসিয়ে ভালো করে বাঁধলাম। ঘরের মাঝখানে ছোট আগুনটার দিকে তিনি ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছেন, কিন্তু পুরো কাণ্ডকারখানাটা সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি। পারলে এত শান্তিপূর্ণ ভাবে কিছুতেই লোকটাকে এখানে আনা যেতো না, কেদার শরীরের যেখানেই চাকু ঢুকানোর হুমকি দিক না কেন।

“আপনি এবার কথা বলতে পারেন।“ আমি আঙ্কেলকে কথা বলার অনুমতি দিলাম। উনি তবু মুখ খুললেন না।

“আরে এখন আর আপনাকে নিয়ে আমাদের কোন ভয় নেই। আপনি চিৎকার করলেও ঠিকমত বাইরে শব্দ যাবে না। আপনি কথা বলুন, চাইলে গানও গাইতে পারেন।“ আমি সাহস দেয়ার চেষ্টা করলাম। আঙ্কেল তখন কেদারের হাতের চকচকে ছুড়িটার দিকে তাকালেন। বেচারার মুখের অর্ধেক ঘাম নিশ্চয়ই গরমের কারণে তৈরি হয় নি। কেদার তখনই ছুড়িটা ছুড়ে ফেলি দিলো। কিছুটা নিরুদ্বিগ্ন হয়ে তিনি তখন মিনমিন করে বললেন, “দেখুন, আমাকে ধরে এনে আপনাদের তেমন লাভ হবে না। আমি সামান্য সরকারী চাকরি করি, বাসায় আমার ওয়াইফ, মা আর চারটে বাচ্চা আছে। আমি গরীব মানুষ, মুক্তিপণ হিসেবে বেশি টাকা দিতে পারবো না।“

“সামান্য কী আবার?” কেদার বললো, “আজকাল তো সবাই সরকারী চাকরিই চাচ্ছে। বেতন-স্কেল আমরা জানি না নাকি? দপ্তর ভালো হলে উপরি আয় তো থাকেই। ভালো বিয়ে করা যায়। টাকা নিয়ে এত চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। দরকার পড়লে আপনার ওয়াইফ বাপের বাড়ি থেকে টাকা যোগাড় করবে।“

আঙ্কেল ঢোক গিললেন, “ইয়ে ওদিকেও অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না কি না।“

“আহা, ব্যাপার তা নয়।“ আমি আস্থা দিলাম, “টাকা-পয়সার কথা হচ্ছে না, টেনশন করবেন না একদম। আপনার সাথে আমাদের কাজটা এই কয়েক ঘণ্টার বেশি নয়।“

আমার মনে হলো আঙ্কেলের মুখের ঘাম অর্ধেক কমে এসেছে, “তারমানে মুক্তিপণের বালাই নেই? তাহলে বাবারা, আমাকে এখানে ধরে এনেছেন কেন? আচ্ছা, আপনারা কি ছদরুল ফকিরের লোক? নিশ্চয়ই তাই। আমি তো উনাকে বলে দিয়েছি টেন্ডারটা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমার অফিসের বড় সাহেবেরও ক্যান্ডিডেট আছে, বুঝলেন তো? বসের উপর গিয়ে ছদরুল সাহেবকে সাহায্য করা কি আমার পক্ষে সম্ভব, বলুন? আচ্ছা, বেশ। বেশ। যদি কাজটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে আমি নাহয় বড় সাহেবকেই অনুরোধ করব। ভালো মানুষ বড় সাহেব, এই তো গত মাসেই আমার বাসায় দাওয়াত খেয়ে গেলেন। বড় সাহেব আমার কথা শুনবেন, দরকার পড়লে আমি পায়ে পড়বো। আপনারা ছদরুল সাহেবকে বলুন চিন্তা না করতে, টেন্ডারটা উনাকে পাইয়ে দেয়ার জন্য আমি জান দিয়ে দেবো।“

“বাহ, আপনার মত ডেডিকেটেড লোক থাকতে ছদরুল ফকিরের আর চিন্তা কী? কেদার, সময় হয়ে এসেছে। আগুনটা জ্বালাও এবার। এই বোতলগুলোর কোন একটায় কেরোসিন আছে দেখ। যেটায় আছে সেটা দূরে সরিয়ে রাখ। অন্ধকারে আরেকটু হলেই কেরোসিন গিলে ফেলেছিলাম। দুটোরই বিদঘুটে গন্ধ।“

কেদার কাজে লেগে গেল। প্রথম প্রথম আমরা ভেবেছিলাম কিছু কাঠের টুকরো একসাথে জড়ো করে তাতে আগুন ধরালেই কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু শুরুরদিকের কাজগুলোতে দেখা গেল নানারকম ঝামেলা। যতই বেঁধে রাখা হোক না কেন, আগুনের তাপে মানুষ ছটফট করবেই, গড়াগড়ি দিয়ে কয়েকজন আগুনের বাইরেও চলে এসেছিলো। কোনমতে ফ্যাসাদগুলো সামলানো হয়েছে। এরপর আমরা অন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। ঘরের মেঝেতে একটা গভীর গর্ত করা হয়েছে, চুল্লি বানানোর সময় কাঠ এমনভাবে সাজানো হয় যেন গর্তের উপরের জায়গাটা খালি থাকে। যখন আমরা একজনকে ছুড়ে মারি তখন তিনি জ্বলন্ত কাঠ ভেঙে নিয়ে গর্তে পরে যান, আর বের হওয়ার উপায় থাকে না। এতসব আয়োজন দেখেও আঙ্কেল চুপ করে রইলেন। সেটা ভয়ে হতে পারে, নির্ভয়েও হতে পারে। বেশি জানলে বেশি আপদ - এ নীতির তিনি সম্ভবত মজবুত বিশ্বাসী।

“তাহলে ভালো ব্যবস্থাই আপনার করা আছে দেখা যাচ্ছে। ছদরুল ফকির আপনাকে দিয়ে টেন্ডার পাইয়ে নেবে আর কিছু দেবে না এমন তো হতে পারে না।“

“আপনারা তো বাবা, সবই জানেন। কিন্তু ব্যবস্থা করা আছে সেরকম কিছু নয়। আসলে, এধরনের কাজ আমি পারতপক্ষে করি না।“ কী বলা ঠিক হবে আর কী বলা ঠিক হবে না এ চিন্তা করে তিনি এ জায়গায় চুপ করে গেলেন। আমি বললাম, “আরে বলুন, বলুন। আপনার একটা কথাও ছদরুল ফকিরের কানে পৌঁছুবে না। আমরাও কিছু ধরবো না, নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে আপনি কথা বলুন।“

“আপনি বড় ভালো লোক। বিশ্বাস করেই বলছি, এধরনের কাজ আমি পারতপক্ষে করি না। ধরুন এই এবারের মত কিছু কেস থাকে, যেগুলো না করলে জান-প্রাণ নিয়ে টানাটানি। আমাকে আপনি করাপ্টেড বলতে পারবে না। আমি একজন আদর্শ নাগরিক, সিস্টেমের মাঝে থাকতে হলে যেটুকু না করলেই নয় তার বাইরে আমি কখনও কিছু করি না।“

“তাহলে তো আপনার জীবনে অনেক কষ্ট।“

“না, না। ছোটখাটো সমস্যা তো থাকবেই। তবু আমরা বড়ো ভালো আছি।“

এসময় দরজায় টোকা পড়লো। প্রথমে তিনটে, তারপর দু’টো, তারপর তিনটে। বাইরে কে, কী কারণে এসেছে তা আমরা দু’জনেই বুঝতে পেরেছি। তবু বাড়তি সতর্কতা বলে একটা কথা আছে। কেদার গিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রাখলো, তারপর খুলে দিলো।

বাজারের দোকানের বাচ্চা ছেলেটা চা আর কোক নিয়ে এসেছে, প্রতিদিন এই সময়েই আসে। শুক্র আর শনিবার বাদে, এ দু’দিন আমরা থাকি না। এক সেকেন্ডের জন্য চেয়ারে বাঁধা মানুষটির দিকে তার চোখদুটো গিয়েই ফিরে এলো, আগুন আর ধোঁয়াকে গ্রাহ্যই করলো না। সারাদিন আগুন দেখেই দিন কাটে ওর। আমার মনে পরে, প্রথমবার যখন ছেলেটি ঘরে ঢুকে দেখেছিলো একজন মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তখন আতঙ্কে পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিলো, হাত-পা-চোখ-মাথা কিছুই আর নড়েনা। ছেলেটা কালো, কিন্তু ওইদিন অন্ধকার ঘরে কেবল আগুনের আলোয় ওকে দেখে মনে হলো ইউরোপিয়ানদের মত ফর্সা হয়ে গেছে। ওর ভয় একেবারে দূর হতে আরও কিছুদিন লেগেছে, কিন্তু এখন ছেলেটা কোন কিছুর তোয়াক্কা  করে না। কে বাঁধা আছে, কে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে এতে তার কিছু যায় আসে না। সত্যি সত্যি কাওকে আগুনে পুড়তে দেখেনি ছেলেটা, তবে আমার ধারনা সে দৃশ্যেও একসময় তার অভ্যাস হয়ে যাবে। বাচ্চারা এমনই। যারা আবর্জনায় জন্ম নেয় তারা নিজেকে আবর্জনাই ভাবতে শুরু করে।

আঙ্কেলের চিৎকার ছেলেটা কানেই তুললো না। প্রতিদিন যেখানে রাখে ঠিক সেখানে চায়ের কাপগুলো আর কোকের বোতলটি রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, “সেলাম ভাইজান।“ আমি মানিব্যাগ থেকে একটা বিশটাকার নোট বের করে ওর হাতে দিয়ে দিলাম। প্রতিদিন এত টাকা বখশিশ দিই না, আজ ভাংতি নেই বলে দিচ্ছি। বড়মাপের ঘুষ পেয়ে ছেলেটি ওর সবগুলো দাঁত আমাকে একবার দেখালো, তারপর কেদারকে এমনকি আঙ্কেলকেও একটা করে সালাম দিয়ে যে দিক দিয়ে এসেছে সেদিক দিয়ে বের হয়ে গেলো।

“চায়ের দোকানে কাজ করে। খুবই ভালো ছেলে।“ আমি বললাম। আঙ্কেল আমার কথায় সায় দিলেন, “হ্যাঁ, সালাম দিলো তো। আদব-কায়দা আছে। লেহাজ ছাড়া এ দুনিয়ায় মানুষের কোন দাম নেই।“

কাঠ সাজানো কেদারের হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা বোতলগুলোর এক একটা নিয়ে সে শুঁকে শুঁকে দেখছিলো। কেরোসিনের ছিপিটা খুলতেই গন্ধটা আমার নাকেও আলতো ধাক্কা মেরে গেল। যতটুকু বোতলে আছে তা দিয়ে এত বড় আগুন জ্বালানো যাবে কি না কে জানে। কেদার কাঠের উপর পুরোটাই ঢেলে দিয়ে কিছু শুকনো খড় জ্বালিয়ে উপরে ছুড়ে মারলো। আমি কথা বন্ধ করে আগুনের দিকে তাকালাম। আগুন পৃথিবীর ভয়ানকতম ছোঁয়াচে রোগ, ছড়িয়ে যেতে মিনিটও লাগে না।

পোড়া-কাঠের গন্ধ যখন সারা ঘরে ছড়িয়ে গেলো তখন আমরা শব্দ করা বন্ধ করে দিয়েছি। কেদার মুগ্ধ চোখে তার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি প্রাণ ভরে কাঠ-পোড়ার ঘ্রাণটুকু উপভোগ করছিলাম। চেয়ারে বসা মানুষটিও কোন কথা বললেন না। পরিবেশের অস্বাভাবিকতা তাকে বাকহারা করে দিয়েছে। তবু কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়, শেষপর্যন্ত আর থাকতে না পেরে আঙ্কেল বলেই ফেললেন, “আগুনটা কি খুবই জরুরী? মানে, আগুন তো আপনারা অবশ্যই জ্বালাবেন। যখন ইচ্ছে জ্বালাবেন। তবে বলছিলাম কি, এটা গরমকাল কি না। আমিও ঘামছি, আপনারাও ঘামছেন। একেবারে নিভিয়ে না দিয়ে অন্তত আঁচটা যদি কিছুটা কমান তাহলে বড় ভালো হয়।“

“বলছেন কি! আগুন নিভিয়ে ফেললে কেমন করে হবে? আগুনটাই তো সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট, ও ছাড়া তো সব আয়োজনই বৃথা। মানে ধরুন আপনার মেয়ের বিয়ে, বিয়েতে বরযাত্রী এলো, খেলো-দেলো, ঘরদুয়ার নোংরাও করলো। তারপর বিয়েটাই হলো না। সে কি ভালো হবে, বলুন?”

“তা তো বটেই, তা তো বটেই।“ আঙ্কেল আমাদের সাথে বেশি তর্কে যেতে চাচ্ছেন না যে তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, “কিন্তু আগুন দিয়ে কী হবে সেটা কী জানতে পারি?“

অনেকক্ষণ ধরেই কেদার কিছু একটা বলার সুযোগ খুঁজছে, এবার সে আর লোভ সামলাতে পারলো না, “ওই আগুনটা আরেকটু ভালো করে জ্বললে আপনাকে ওখানে পোড়ানো হবে।“

আকস্মিকতার একটা মাত্রা থাকে। সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মানুষ অবাক না হয়ে অন্য কিছু করে বসে। কেদারের কথা শুনে আঙ্কেল বাস্তবিকই হা করে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। “আমাকে পোড়ানো হবে?” হঠাৎ দমকে দমকে হাসতে শুরু করে এক লাফে তিনি অট্টহাসিতে পৌঁছে গিয়ে ঘরটাই কাঁপিয়ে দিলেন, “আমাকে পুড়িয়ে কি খাবেন নাকি বাবারা? আগেই বলে রাখি, আমি বুড়ো মানুষ, ডায়াবেটিসের রোগী। আমাকে খেতে একেবারেই ভালো লাগবে না। তবে ভালো করে লবণ আর মশলা যদি মাখিয়ে নেন তবে অন্য কথা। লবণ-মশলা কি আছে?“

“না, না, সে প্রশ্নই আসে না।“ আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, “আমরা যথেষ্ট সিভিলাইজড মানুষ, একেবারেই নরখাদক নই। ক্যানিব্যালিজমের মত বর্বর কাজ আমি কিছুতেই সাপোর্ট করি না। আগুনে নিক্ষেপ করার বিষয়টা সম্পূর্ণ আগুনের জন্যই, আপনি জ্বলেপুড়ে মারা যাওয়ার পর আপনার দেহের কোন ক্ষতি করা হবে না। তাছাড়া আপনি মুসলমান মানুষ, শবদাহ তো আর করা যাবে না। যা অবশিষ্ট থাকবে তা আমরা কবর দেয়ার ব্যবস্থা করব, লোক আছে আমাদের। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না আপনি, ধরে নিন আপনার ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছিল তাতে পুড়ে আপনি মারা গেছেন। এ ঘটনা তো ঘটছেই দেশে, কেউ তো কোন আপত্তি করছে না।”

মানুষটির চোখ তখন গোল ও লাল হয়ে গেছে, তার কতটুকু ধোঁয়ায় কতটুকু অবিশ্বাস আর আতঙ্কে কে জানে, “কিন্তু আমি তো বললাম ছদরুল ফকিরের কাজটা আমি ম্যানেজ করে দেবো। আল্লাহর কসম, আমার সন্তানের কসম দিয়ে বলছি বাবারা, আমার কথার বিন্দুমাত্র খেলাপ হবে না।“

“আমরা ছদরুল ফকিরের লোক আপনাকে কে বলল? সেটা আপনি অনুমান করেছেন মাত্র। আমাদের কাজটা একটা বেসরকারি প্রজেক্ট। আমরা সুখী মানুষদের ধরে আনি, তাদের আগুনে ছুঁড়ে মারি। আপনি সুখী মানুষ, তাই আপনাকে আনা হয়েছে। ছদরুল ফকির যদি সুখী মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো তাকেও আনা হবে, কিংবা আপনার অফিসের বড় সাহেব।“

যখন আঙ্কেল পুরোপুরি বুঝতে পারলেন তার সাথে কী হতে যাচ্ছে তখন যে হাউমাউ কান্না শুরু করলেন তার জন্য আমি অপ্রস্তুত ছিলাম তা বলা যাবে না। একটা পর্যায়ে এসে সবাই কাঁদে, “আব্বা, আপনারা আমার আব্বাজান। আমি একেবারেই সুখী মানুষ না। আমার জীবনে অনেক কষ্ট। আমার ডায়াবেটিস। আমার বউয়ের বাতের বেদনা। চারটে সন্তান আমার, ইচ্ছে থাকলেও মনে হয় আর একটা নেয়ার সুযোগই পাবো না কোনদিন আর। আমার আম্মা চোখে দেখে না ঠিকমত। আমার বড় ছেলেটা অকর্মার ঢেঁকি হইছে একটা। বড় মেয়ে সারাদিন মোবাইল নিয়া পইড়া থাকে। ছোটগুলার পড়াশুনায় মনোযোগ নাই, ক্লাসে রেজাল্ট খারাপ। আব্বা, আমার জীবনে কোন সুখ নাই। আমারে যাইতে দেন, আল্লাহর দোহাই।“

“কী আশ্চর্য! একটু আগেই তো বললেন আপনি বড়ো ভালো আছেন।“ আমার কথার পেছনে কেদার চোখ রাঙালো, “তখন এক কথা, পরিস্থিতি বুঝে অন্য কথা! আপনাকে তো আমি ভদ্রলোক ভেবেছিলাম।“

“বাবা, এসব করে কী হবে বলো বাবা? কেন শুধুশুধু মানুষরে কষ্ট দিচ্ছ? তোমার মাথায় হয়তো অনেক রাগ, অনেক ঘৃণা। কিন্তু মানুষের উপর নির্যাতন করে তোমাদের কোন লাভ হবে না বাবা।“

“আরে এসব আপনাকে কে বললো?” আমি জবাব দিলাম, “রাগ, ঘৃণা থাকবে কেন? আমাদের প্রজেক্টের কোন বড় ফোকাস নেই বললাম কি না? সুখী মানুষদের আগুনে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাই ছুঁড়ে মারছি। এটা তো সহজ কথা।“

কান্নাকাটি আর বেশিক্ষণ চললো না। জ্বলদগ্নির তাপে আঙ্কেলের মাথায়ও একসময় আগুন জ্বলে গেলো, “এই শুয়োরের বাচ্চারা, তোরা ভাবছিস তোরা পার পেয়ে যাবি? তোরা নিজের মা’রে দিয়ে খানকিগিরি করানোর যোগ্য না কুত্তার বাচ্চারা, তোরা আমারে পোড়াবি? দেশে বিচার আছে, আইন আছে। জীবনে আইন বানান করতে শিখছস শালা খানকির ছেলেরা? পুলিশ ধরে নিয়ে যখন পেছন দিয়ে আলু ঢুকাবে তখন বুঝবি। ক্রসফায়ারে মরবি তোরা কুত্তার বাচ্চারা, ক্রসফায়ারে মরবি।“

“আপনার কথাবার্তা তো অত্যন্ত ভালগার রে ভাই!“ আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম, “এই কথাগুলো ভদ্রভাবে বললে সমস্যাটা কোথায়? আপনার ধারনা আমরা ঘাস খাই? আমার বাবার টাকা আছে, ক্ষমতা আছে। কতটা আছে সেটা আপনার কল্পনার বাইরে। আইন-বিচার আমাকে দেখাবেন না। আমরা অন্য জাত, স্যার। আমি ক্রসফায়ারে মরি না, আমি ক্রসফায়ার করাই। আইনের হাত যতই লম্বা হোক না কেন, পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছুবে না।“

“হারামজাদা খানকির পোলার চাঁদ দেখাচ্ছিস তোরা পাবলিক জানলে তোদের শরীর থেকে হাত-পা গুলো ছিঁড়ে ফেলবে।”

“এটা আঙ্কেল বাড়িয়ে বলছেন।“ আমি হেঁসে উঠলাম, “পাবলিক তো জানে! আমরা আর কী করছি, এরচেয়ে ভয়ানক কাজকর্ম হচ্ছে না? মানুষজনের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই এসবের পেছনে ছুটবে।“

এসময় দরজায় আবার টোকা পড়লো। টোকা তো না, পড়লো থাবা। হাতের আঘাতে লোহার দরজায় ধুম করে একটি শব্দ হলো, তারপর কিছুক্ষণ পরপর শব্দ হতেই লাগলো। দরজা না খোলা পর্যন্ত এ শব্দ বন্ধ হবে না। এধরনের কোন সংকেত আমার জানা নেই। আমি আঙ্কেলের মুখ চেপে ধরলাম, যাতে কোন শব্দ করতে না পারেন, “কেদার, কে এসেছে দেখ। ছুড়িটা তোলে নাও।“

কেদার মেঝে থেকে তার চকচকে অস্ত্রটি তুলে নিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রেখেই আঁতকে উঠলো, “স্যার, ঝামেলা হয়েছে।“

“কী ঝামেলা হয়েছে?”

“বড় স্যার দাঁড়িয়ে আছেন।“

কেদার একজন মানুষকেই বড় স্যার বলে, তিনি আমার বাবা। আমাদের কাজ সম্পর্কে বাবা কিছু জানতেন না, কিন্তু এখন নিশ্চয়ই জানেন। সম্ভবত আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছিলেন, সে সূত্র ধরে এখানে এসে পৌঁছেছেন। বাবা কখনও আমার বিরুদ্ধে কিছু করবেন না আমি জানি, কিন্তু তাকে বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখার সাহস আমারও নেই, “দরজা খোলে দাও, আর তাড়াতাড়ি হাতের জিনিসটা নিচে ফেলো।“

কেদার দরজা খুলে দিলো, বাবা ভেতরে ঢুকলেন। তাকে যদি সুতোর সাথে তুলনা দিই তবে বলতে হবে এই সুতোর কিনারা আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। লাখটাকার স্যুট আর গোল্ডরিম চশমা পরলেই এই গাম্ভীর্য আর আভিজাত্য কেউ অর্জন করতে পারেন না। নিজের চারপাশে দম্ভ, অর্থ ও ক্ষমতার যে দেয়াল তিনি বানিয়ে রেখেছেন তা আজ পর্যন্ত কেউ ভেদ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তবু, সে দেয়ালের ইটের ফাঁকে উঁকি দিলে বাবার কিছু খেয়াল চোখে পড়ে যায়। ছোটবেলায় একবার বাবার ব্যক্তিগত আলমারি ঘাটতে গিয়ে একটা দলিল খুঁজে পেয়েছিলাম। সে দলিলে স্পষ্ট লেখা ছিলো এই দেশ ত্রিশ লক্ষ ছিয়াশি হাজার টাকায় বাবার নামে লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে। এর নিচে যাদের স্বাক্ষর ছিলো তাদের কয়েকজনের নাম আমি ওই বয়সেও জানতাম, প্রধানমন্ত্রীর-রাষ্ট্রপতির নাম স্কুলে না শেখার কোন উপায় তো ছিলো না।

কোন খেয়ালে বাবা এ নকল দলিলটি তৈরি করে রেখে দিয়েছিলেন আমি জানি না, কিন্তু যে জ্ঞান নিয়ে সেই বাল্যকাল থেকে এতদূর এসেছি সে জ্ঞান কি চাইলেও একেবারে মুছে ফেলা যায়?

বাবা কখনও মাথা গরম করেন না, তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ঘরের সবকিছু একবার দেখে নিলেন। ঘরের মাঝে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড, চেয়ারে বাঁধা একজন মানুষ, মেঝেতে রাখা চায়ের কাপ আর কোকের বোতল, ভাঙা রিভলভিং চেয়ার, স্টেইনলেস স্টিলের ছুড়ি, কাঁচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকা কেদার, হতভম্ব আমি।  স্তম্ভকে কোন কিছুই স্তম্ভিত করতে পারে না, চশমার পেছনে তার চোখদুটোর যেন ভুল করেও অবাক হওয়ার ক্ষমতা নেই, “এই চলছে তাহলে? প্রতিদিন? তুমি যে একটা আনকালচারড আনসোশ্যাল রাস্কেলে পরিণত হয়েছ তা বুঝতে পারছ? তুমি জানো তোমার মা যদি জানতে পারে তাহলে কী অবস্থা হবে? সে চিন্তা করেছিলে?”

বাবা কেদারের দিকে ফিরলেন। কেদার যখন আমাদের বাড়িতে প্রথম আসে তখন আমি অনেক ছোট। ওর কাজ ছিলো চোখ বন্ধ করে আমার সব কথা শোনা। আমার সাথে স্কুলে যেতে বললে স্কুলে যাওয়া। আমার সাথে খেতে বললে খাওয়া। আমি পা টিপে দিতে বললে পা টিপে দেয়া। যদি আমি চাই তাহলে আমার সামনে নগ্ন হয়ে দাড়িয়ে থাকা। আমি রক্ত দেখতে চাইলে হাত কেটে রক্ত বের করা। কেদারের নিজের কোন ইচ্ছে যে নেই তা বাবা জানতেন, তাই ওর উপর কোন অভিযোগ তিনি করলেন না, “এ গরম সহ্য হচ্ছে না। কেদার, আগুন নেভা।“

আমি কথা বলার শক্তি-সাহস-স্পর্ধা সব হারিয়ে ফেলেছি। বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন, “তুমি নির্লজ্জের মত একটা কাজ করবে সেটা আমি চিন্তাও করতে পারি নি। তোমার সাহস কত হয়েছে যে তুমি ভাবছ আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার তোমার আছে?”

“কিন্তু আমি তো তেমন কিছু করি নি।“

“কর নি মানে? তুমি কোন সাহসে শিউলিমালাকে এখানে ধরে এনে পুড়িয়ে মারার ভয় দেখিয়েছ? I admit, I slept with her. মেয়েটা অন্যরকম, ওর প্রতি আমার একটা আকর্ষণ জন্মেছিলো। She never refused. এটা নতুন কিছু নয়, আগেও ঘটেছে। তোমার মা’ও খুব ভালো করেই জানে। হ্যাঁ, সে কষ্ট পেয়েছে কিছুটা। কিন্তু আমার কমিটমেন্ট সবসময় তার প্রতিই ছিলো, those were just physical necessity. তুমি আমার ছায়ায় বড় হয়েও এত নোংরা একটা কাজ করবে তা আমি ভাবতে পারি নি।“

মা যা জানে, আমিও তা জানি। জানার পর হয়তো তার উপর ঘৃণা জন্মানোর কথা ছিলো, কিন্তু জন্মায়নি। সাম্রাজ্যের ইতিহাস কখনও বিশুদ্ধ হতে পারে না। বাবাকে আমি কখনও নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখিনি, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আমার করার নেই। তবু মাঝে মাঝে সবাই ভুল করে। অনেক বছর আগে মা’য়ের দিক থেকে আমার দুঃসম্পর্কের এক বোন আমাদের বাড়িতে থাকতে এসেছিল, বয়সে আমার বেশ বড়ই হতো সে। সারাদিন ওর সাথেই ছুটোছুটি করতাম আমি। কেদারকে তখনও নিয়ে আসা হয়নি, বড় হলেও ওই একজনই ছিলো আমার খেলার সাথী। যখন হঠাৎ একদিন সে আর রইলো না তখন আমি কান্নাকাটি করেছিলাম খুব। প্লেট ছুড়ে ভেঙে ফেলেছিলাম ডাইনিং টেবিল থেকে। কিন্তু কেদারকে নিয়ে আসা হলো, আমি অতীতের কথা সব ভুলে গেলাম। আসলে, আমাদের বাসায় এত বাড়তি প্লেট ছিলো যে এক দু’টো ভাঙলে কিছুই যায় আসে না।

ঐ দুঃসম্পর্কের বোনের নামটা আমার মনে না থাকলেও তা শিউলিমালা হতে পারে না। কারণ Sheulimala never refused. মেয়েটি কে তা আমি এখন অনুমান করতে পারছি, “শিউলিমালা কি খাটো করে শ্যামলা সবুজ শার্ট পরা মেয়েটা? যাকে আমি এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলাম।”

“সবুজ শার্ট পরা কি মানুষের পরিচয় হতে পারে?”

“বাবা, ওই মেয়েটাকে আমি চিনতাম না, বিশ্বাস কর। ওর সাথে তোমার পরিচয় আছে তাও আমি জানতাম না।“ আমি বাবার হাতদু’টো ধরলাম, “আমি তোমাকে ছুঁয়ে বলছি। Believe me, dad. I swear I didn’t know who she was.”

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “সত্যিই জানো না বলছ?”

“হ্যাঁ বাবা, সত্যি।“

“আমি অবশ্য এমন একটা কিছুই অনুমান করেছিলাম। তুমি মানসিক ভাবে পুরোপুরি ঠিক নও, কেন এমন হলো আমি জানি না। কিন্তু নোংরামি জিনিসটা আমার ছেলের মাঝে থাকতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। তবুও, তুমি একটা ভয়ানক ক্রাইম করে ফেলেছ। তুমি কেন করেছ আমি জানি না, কিন্তু তুমি নিজের হাতে এই অপরাধগুলো ঘটিয়েছ। নিরপরাধ মানুষ মারা গেছে। এর শাস্তি তোমার পেতে হবে। এ কাজ আজ থেকে বন্ধ। আর তোমার শাস্তির ব্যবস্থা বাড়ি গিয়ে করছি।“

কেদার আগুন নিভিয়ে ফেলেছে ততোক্ষণে। বাবা চেয়ারে বাঁধা আঙ্কেলের দিকে ফিরলেন, “দেখুন, ছোট মানুষ, ভুল করে ফেলেছে। ওরা আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। লোক জানাজানি হলে আপনার-আমার দু’জনেরই সমস্যা, সুতরাং তার কোন প্রয়োজন নেই।“

“স্যার, ওরা আমাকে আগুনে পুড়িয়ে…”

“মজা করে ভয় দেখিয়েছে, পোড়ায়নি তো আর। আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি, বাড়ি চলে যান। কেদার, বাঁধন খুলে দে।“

আঙ্কেল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু তার দাঁড়ানোতে ভরসার কোন চিহ্ন আমি দেখতে পেলাম না। কুঁজো হয়ে হেঁটে তিনি বাইরে চলে গেলেন, একটিবারের জন্য পেছনে ফিরে তাকালেন না। এই হাঁটার ভঙ্গিমাটা তাকে দারুণ মানিয়েছে বলতে হবে। আমার মনে হয় তিনি সবসময় কুঁজো হয়েই হাঁটেন। মাঝে মাঝে দেখা যায়, মাঝে মাঝে দেখা যায় না। আমার আর কিছু বলার ছিলো না। কেদার কেবল প্রশ্ন করলো, “বড় স্যার, এভাবে যেতে দিলেন?”

“কিছু হবে না। দু’দিন পরই সবকিছু ভুলে যাবে। এই মানুষদের নিয়ে কোন ভয় নেই।“

চায়ের দোকানের ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে দূরে, কাপগুলো ফিরিয়ে নিতে আসছে। ছোট মানুষ। আমরা কাল থেকে আর থাকবো না, কিন্তু আমার ধারনা আরও কয়েকদিন ও চা নিয়ে আসবে। বাবা বললেন, “আর শিউলিমালাকে নিয়ে চিন্তা করো না। পিক্যুলিয়ার মেয়ে। ওর তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।“

আমার কেন যেন মনে হলো আমি আগুনে শিউলিমালাকেই বারবার ছুড়ে ফেলেছি।

The cover photo used is Edvard Munch's self portrait in hell. Munch was famous for his expressionist form of artworks.

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।

0 comments: