ধূসর
বাচ্চা দু’জন। বাঁচাতে হবে একজনকে।
আস্ত ঝামেলায় পড়া গেলো, ভাবলো কুদরত। আসলে, বাসার মানুষদেরই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব রয়েছে। নয়তো দু’টো ছোট বাচ্চার সাথে কুদরতকে রেখে চলে যেতো না কেউ। মনে মনে সবাইকে অভিশাপ দিলো একবার করে সে। অভিশাপ দিলো বাড়ির মালিককে। ঘোড়ার ডিমের বাড়ি বানিয়েছে শালা, কেমিক্যালের গুদামের ওপরে। আগুন লেগে দুই মিনিটেই সর্বনাশ। এখনই বের হতে না পারলে ছাইভস্ম হওয়াই ভাগ্যে থাকবে।
সরকারের কোন চিন্তা নেই, এ অভিযোগও আছে তার। হারামজাদাদের কাজ অফিসে বসে বসে ঘুষ খাওয়া আর পাবলিকের টাকায় নবাবী করা। কেউ খেয়াল রাখবে না এই বিল্ডিঙের নিচে এত এত কেমিক্যাল পড়ে আছে। আগুন তো আগেও লেগেছে এভাবে। সরকার, পুলিশ ও বাড়িওয়ালাদের অকার্যকারিতা যে একই সাথে পাশবিক এবং শাস্তিযোগ্য সে সিদ্ধান্তে এলো ও।
কিন্তু বাঁচানো যায় কাকে?
ট্রাক চাপা দিয়ে তার ডানহাতটা গুড়িয়ে পা খোঁড়া করে দিয়েছে যে ড্রাইভার তাকেও অভিশাপ দিলো কুদরত। জাহান্নামে যাক শুয়োরটা, মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আপনাআপনি। এক দলা থুতু ছুঁড়ে ফেললো চকচকে কাঁচের টেবিলের ওপর। বাড়ি থাকলো তো টেবিলের চিন্তা। একহাতে বাচ্চা কোলে করে এই গরম আর ধোঁয়ার মাঝে চারতলা থেকে নিচে নামা সহজ কাজ? শালা তুই তোর বউ-বাচ্চা নিয়ে জ্যান্ত পুড়ে মর।
আগুন ভালো করে লাগেনি এখনও, আর এক মিনিট লাগবে। চিৎকার শুরু হয়ে গেছে তবু। দমকল ডাকা হলেও লাভ নেই। এ চিপাগলিতে গাড়ি ঢুকবে না। প্ল্যান কে করে এসবের, আগুন থামবে এক বিল্ডিঙে লেগে? আরও লাগবে, পাশেরগুলোও ছাই হবে। হোক। মানুষ কিছু মরুক। কুদরত একা ভুগবে কেন?
কিন্তু বাচ্চা একটাকে বাঁচাতে হবে। বড়ভাবীর মেয়েটা মাশাল্লা, হয়েছে ফুটফুটে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, ডাগর ডাগর চোখ। মুখে সুন্দরী মায়ের আদল স্পষ্ট। একটু একটু কথাও বলতে পারে। ফোকলা দাঁতে কী সুন্দর হাঁসে মেয়েটি। এসব কথাই কুদরতের মনে এলো। এত সুন্দর মেয়েটা বড় হবে না, আগুনে পুড়ে মরে যাবে ভাবতেই কষ্ট হলো তার।
মমতাজের ছেলেটার বয়স বড়ভাবীর মেয়ের সমান। এ বাচ্চাটা কুৎসিতই হয়েছে, ভাবে কুদরত। কুচকুচে কালো হয়ে পৃথিবীতে এসেছে ছেলে। মুখের মাপজোখ ঠিক নেই, নাকের ডগাটা ওপরের দিকে ওঠে থাকে। আর কপালটাও কিছুটা বড়। স্বভাবটা বলতে গেলে ভালো নয়। মনে আছে সব কুদরতের। কিছুদিন আগেই ওর কোলে ওঠে জামাকাপড় নষ্ট করেছে হতচ্ছাড়া।
মেয়েটা মরলে বড় দুঃখ পাবে বড়ভাবী। কী যে আদর করেন বাচ্চাটাকে তিনি, চোখের মণি একেবারে। ওর জন্য গুড়াদুধ আনতেই মমতাজকে নিয়ে এ অসময়ে নিচে নেমেছেন তিনি। দুধ ছিলো বাক্সে, বানানোর সময় অসাবধানে সবটা মেঝেতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। নাহ, স্বীকার করবেই সে, ভালোবাসেন মেয়েকে বড় ভাবী। না বেসে উপায় কী? এত চেষ্টা চরিত্র করে, এলোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি পীর-ফকির ধরে এতদিন পর একটা সন্তান এসেছে ঘরে। গ্রামে দুর্নাম কম তো হয়নি ওদের, সবাই বলাবলি করতো অলক্ষণে মহিলা বলেই নাকি পেটে বাচ্চা বাঁচে না। এবার মুখ বন্ধ হয়েছে তো সবার।
মমতাজ অবশ্য টেরও পাবে না একটা ছেলে মরলে, কুদরতের তাই ধারনা। এটা সম্ভবত সাত নম্বরই হবে, আটও হতে পারে। আগের পক্ষেরও আছে দুজন। বাড়িতে বাচ্চা গিজগিজ করছে, দুইজনের খবর রাখলে তিনজন হারিয়ে যায়। যেগুলো বড় হয়ে গেছে সেগুলোও কোন কাজে আসে না, অকর্মণ্যের বাদশা সব। একটা কমলে হয়তো খারাপ কিছু হবে না, কুদরত নিজেকে বললো। না, প্রথমে কান্নাকাটি করবে সবাই। তারপর ঠিক হয়ে যাবে, হয়তো এতে ভালোই হবে সবার জন্য দিনশেষে। খেয়াল রাখার ঝামেলা থাকবে না, সম্পত্তির ওয়ারিশানও কমবে। বাচ্চা অসুখেও তো মরে।
বড়ভাইও মেয়ে মারা গেলে কষ্ট পাবে। কিন্তু মমতাজের স্বামীর বুকের মাঝে হৃদয় বলতে কিছু নেই। টাকা থাকলে কী হবে, শালা একটা কঞ্জুস, খবিশ। আড্ডায় বসে বিঁড়ি খাওয়া আর বাচ্চা পয়দা করা ছাড়া কিছু পারে না জানোয়ারটা। জমিজমার দেখভাল সব করে তো মোক্তার দেওয়ান। সম্পদ কম নেই ব্যাটার।
টাকা চেয়েছিলো কিছু কুদরত, মুখের ওপর না করে দিয়েছে। বউয়ের আপন বড় ভাই, কিছু দিতে তো পারতো। মদ-গাঁজা খেয়ে তো আর উড়াতো না সে, ব্যবসাই করতো। ট্রাক চাপা পড়ে হাত একটা গেছে, ডান পা’টাও নষ্ট। নয়তো কামাতে পারতো না কুদরত? করতোই তো চাকরি। সবশালা বেঈমান, স্বার্থপর।
বড়ভাই কিছু অবশ্যই দেবে, ভাবে কুদরত। হোক চাচাতো ভাই, কিন্তু ভাই তো। যোগাযোগ অনেকদিন নেই, তাই জোর দিয়ে চাওয়ার জন্য মমতাজকেও সাথে এনেছে সে। দশ বাচ্চার মা মমতাজ, হু হু। মানুষ ভুলানোর কৌশল জানা আছে তার। স্বামীর মত নিষ্ঠুর না, ভাইয়ের জন্য দরদ আছে দিলে।
এই প্রথম বোনের জন্য খারাপ লাগলো কুদরতের। আহারে, বেচারি। কোলের বাচ্চাটা, আদর করে নাম রেখেছে সোনা। মারা গেলে মায়ের মন কষ্ট পাবে না একটুও?
তাছাড়া, কুদরত তো আপন মামা। কল্পনা করলো ও, সোনাকে যদি বাঁচাতে পারে তবে আর একটু বড় হলেই নিজের কাছে নিয়ে যাবে সে। বড় করবে নিজের সন্তানের মত। হলোই না হয় কুৎসিত, দিলটাই বড় জিনিস। জ্ঞান-সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ।সোনাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে ও, কলেজ পাশ করলে বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াবে। মামাতো তো ভুলে যাবে না ছেলেটা। মনে রাখবে। বুড়ো বয়সে দেখভাল করবে।
কিন্তু মেয়ে মারা গেলে বড়ভাইও ভেঙে পড়বে। এ অবস্থায় টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু মেয়ে বেঁচে গেলে অন্য কথা। বড়ভাই-ভাবী কী খুশিটাই হবে! কুদরতকে কিছু চাইতে হবে না। বড়ভাই এমনিতেই টাকা দিয়ে দেবে। ব্যবসাতেও সাহায্য করবে। আর এই মেয়েটাও একদিন বড় হবে, বিয়ে হবে তার। তখন বিয়েতে ডাকবে না ওকে? সবাইকে বলবে না বড়ভাই কুদরতের জন্যই তার মেয়ের জীবন রক্ষা হয়েছে?
কুদরত বলবে, সবাই আল্লাহর কুদরত ভাইজান, এই কুদরত তো কেবল উছিলা।
তবু, বাচ্চাদের মাঝে পার্থক্য করা যায় না, ভাবে সে। যদি সুযোগ থাকতো তবে দু’জনকেই নিশ্চয়ই বাঁচাতাম। সব দোষ শালা ট্রাকড্রাইভারের, হাতটা নষ্ট করে দিলো। আর মমতাজের স্বামী হারামজাদা টাকাটা দিলো না, দিলে এ হাঙ্গামায় পড়তাম আমি? কিছুতেই না।
হাহাকার, আর্তনাদ বাড়ছে। এখন নামতেই হয়, নয়তো একজনের জায়গায় তিনজন মরবে। একবার মাথায় এলো ডেকে দেখবে কেউ সাহায্য করতে আসে কি না। না, আসবে না। সবার জান নিয়ে টানাটানি। সবাই নিশ্চয়ই নিচে চলে গেছে, যারা যায়নি তারা চোখ বন্ধ করে ছুটছে। কেউ সাহায্য করতে আসবে না।
মমতাজের ছেলে সোনা চোখ বন্ধ করে ঘুমায়। কিছুক্ষণ পর ঘর যখন ধোঁয়ায় ভরে গেছে তখন ঘুম ভাঙে সোনার। জানালার কার্নিশে আগুন পৌঁছে গেছে, পোড়া কাপড় ছিঁড়ে পড়ে গেছে বিছানায়। চাদরে আগুন ধরলো। নিঃশ্বাস নেয়া যায় না, কালো ধূম্র চোখ জ্বালিয়ে দেয়। কান্না শুরু হয়। এক বছরের শিশুর চলন ক্ষমতা থাকে না। আগুন যখন ওর শরীরে লাগলো তখন দুনিয়ার সমস্ত ভয়, বেদনা, বিভীষিকা এক খণ্ডে মিশে গেলো কান্নার সাথে। বেশিক্ষণ নয়। জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার আগেই নিঃশ্বাস বন্ধ হলো তার। সোনার ছোট ছোট চুলগুলো পুড়ছে তখন, বেড়ালের ছবি বসানো ছোট প্যান্ট আর নীল জামাটাও পুড়ছে। দগ্ধ মাংসের ঘ্রাণ নেয়ার কেউ অবশিষ্ট নেই আশেপাশে। সিলিং এর ফ্যানটি খুলে পড়ে যায় একসময় অঙ্গার রাঙা লাশটির ওপর। আরও অনেকক্ষণ সময় গেলে ছাই হয়ে যাবে সব।
আস্ত ঝামেলায় পড়া গেলো, ভাবলো কুদরত। আসলে, বাসার মানুষদেরই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব রয়েছে। নয়তো দু’টো ছোট বাচ্চার সাথে কুদরতকে রেখে চলে যেতো না কেউ। মনে মনে সবাইকে অভিশাপ দিলো একবার করে সে। অভিশাপ দিলো বাড়ির মালিককে। ঘোড়ার ডিমের বাড়ি বানিয়েছে শালা, কেমিক্যালের গুদামের ওপরে। আগুন লেগে দুই মিনিটেই সর্বনাশ। এখনই বের হতে না পারলে ছাইভস্ম হওয়াই ভাগ্যে থাকবে।
সরকারের কোন চিন্তা নেই, এ অভিযোগও আছে তার। হারামজাদাদের কাজ অফিসে বসে বসে ঘুষ খাওয়া আর পাবলিকের টাকায় নবাবী করা। কেউ খেয়াল রাখবে না এই বিল্ডিঙের নিচে এত এত কেমিক্যাল পড়ে আছে। আগুন তো আগেও লেগেছে এভাবে। সরকার, পুলিশ ও বাড়িওয়ালাদের অকার্যকারিতা যে একই সাথে পাশবিক এবং শাস্তিযোগ্য সে সিদ্ধান্তে এলো ও।
কিন্তু বাঁচানো যায় কাকে?
ট্রাক চাপা দিয়ে তার ডানহাতটা গুড়িয়ে পা খোঁড়া করে দিয়েছে যে ড্রাইভার তাকেও অভিশাপ দিলো কুদরত। জাহান্নামে যাক শুয়োরটা, মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আপনাআপনি। এক দলা থুতু ছুঁড়ে ফেললো চকচকে কাঁচের টেবিলের ওপর। বাড়ি থাকলো তো টেবিলের চিন্তা। একহাতে বাচ্চা কোলে করে এই গরম আর ধোঁয়ার মাঝে চারতলা থেকে নিচে নামা সহজ কাজ? শালা তুই তোর বউ-বাচ্চা নিয়ে জ্যান্ত পুড়ে মর।
আগুন ভালো করে লাগেনি এখনও, আর এক মিনিট লাগবে। চিৎকার শুরু হয়ে গেছে তবু। দমকল ডাকা হলেও লাভ নেই। এ চিপাগলিতে গাড়ি ঢুকবে না। প্ল্যান কে করে এসবের, আগুন থামবে এক বিল্ডিঙে লেগে? আরও লাগবে, পাশেরগুলোও ছাই হবে। হোক। মানুষ কিছু মরুক। কুদরত একা ভুগবে কেন?
কিন্তু বাচ্চা একটাকে বাঁচাতে হবে। বড়ভাবীর মেয়েটা মাশাল্লা, হয়েছে ফুটফুটে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, ডাগর ডাগর চোখ। মুখে সুন্দরী মায়ের আদল স্পষ্ট। একটু একটু কথাও বলতে পারে। ফোকলা দাঁতে কী সুন্দর হাঁসে মেয়েটি। এসব কথাই কুদরতের মনে এলো। এত সুন্দর মেয়েটা বড় হবে না, আগুনে পুড়ে মরে যাবে ভাবতেই কষ্ট হলো তার।
মমতাজের ছেলেটার বয়স বড়ভাবীর মেয়ের সমান। এ বাচ্চাটা কুৎসিতই হয়েছে, ভাবে কুদরত। কুচকুচে কালো হয়ে পৃথিবীতে এসেছে ছেলে। মুখের মাপজোখ ঠিক নেই, নাকের ডগাটা ওপরের দিকে ওঠে থাকে। আর কপালটাও কিছুটা বড়। স্বভাবটা বলতে গেলে ভালো নয়। মনে আছে সব কুদরতের। কিছুদিন আগেই ওর কোলে ওঠে জামাকাপড় নষ্ট করেছে হতচ্ছাড়া।
মেয়েটা মরলে বড় দুঃখ পাবে বড়ভাবী। কী যে আদর করেন বাচ্চাটাকে তিনি, চোখের মণি একেবারে। ওর জন্য গুড়াদুধ আনতেই মমতাজকে নিয়ে এ অসময়ে নিচে নেমেছেন তিনি। দুধ ছিলো বাক্সে, বানানোর সময় অসাবধানে সবটা মেঝেতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। নাহ, স্বীকার করবেই সে, ভালোবাসেন মেয়েকে বড় ভাবী। না বেসে উপায় কী? এত চেষ্টা চরিত্র করে, এলোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি পীর-ফকির ধরে এতদিন পর একটা সন্তান এসেছে ঘরে। গ্রামে দুর্নাম কম তো হয়নি ওদের, সবাই বলাবলি করতো অলক্ষণে মহিলা বলেই নাকি পেটে বাচ্চা বাঁচে না। এবার মুখ বন্ধ হয়েছে তো সবার।
মমতাজ অবশ্য টেরও পাবে না একটা ছেলে মরলে, কুদরতের তাই ধারনা। এটা সম্ভবত সাত নম্বরই হবে, আটও হতে পারে। আগের পক্ষেরও আছে দুজন। বাড়িতে বাচ্চা গিজগিজ করছে, দুইজনের খবর রাখলে তিনজন হারিয়ে যায়। যেগুলো বড় হয়ে গেছে সেগুলোও কোন কাজে আসে না, অকর্মণ্যের বাদশা সব। একটা কমলে হয়তো খারাপ কিছু হবে না, কুদরত নিজেকে বললো। না, প্রথমে কান্নাকাটি করবে সবাই। তারপর ঠিক হয়ে যাবে, হয়তো এতে ভালোই হবে সবার জন্য দিনশেষে। খেয়াল রাখার ঝামেলা থাকবে না, সম্পত্তির ওয়ারিশানও কমবে। বাচ্চা অসুখেও তো মরে।
বড়ভাইও মেয়ে মারা গেলে কষ্ট পাবে। কিন্তু মমতাজের স্বামীর বুকের মাঝে হৃদয় বলতে কিছু নেই। টাকা থাকলে কী হবে, শালা একটা কঞ্জুস, খবিশ। আড্ডায় বসে বিঁড়ি খাওয়া আর বাচ্চা পয়দা করা ছাড়া কিছু পারে না জানোয়ারটা। জমিজমার দেখভাল সব করে তো মোক্তার দেওয়ান। সম্পদ কম নেই ব্যাটার।
টাকা চেয়েছিলো কিছু কুদরত, মুখের ওপর না করে দিয়েছে। বউয়ের আপন বড় ভাই, কিছু দিতে তো পারতো। মদ-গাঁজা খেয়ে তো আর উড়াতো না সে, ব্যবসাই করতো। ট্রাক চাপা পড়ে হাত একটা গেছে, ডান পা’টাও নষ্ট। নয়তো কামাতে পারতো না কুদরত? করতোই তো চাকরি। সবশালা বেঈমান, স্বার্থপর।
বড়ভাই কিছু অবশ্যই দেবে, ভাবে কুদরত। হোক চাচাতো ভাই, কিন্তু ভাই তো। যোগাযোগ অনেকদিন নেই, তাই জোর দিয়ে চাওয়ার জন্য মমতাজকেও সাথে এনেছে সে। দশ বাচ্চার মা মমতাজ, হু হু। মানুষ ভুলানোর কৌশল জানা আছে তার। স্বামীর মত নিষ্ঠুর না, ভাইয়ের জন্য দরদ আছে দিলে।
এই প্রথম বোনের জন্য খারাপ লাগলো কুদরতের। আহারে, বেচারি। কোলের বাচ্চাটা, আদর করে নাম রেখেছে সোনা। মারা গেলে মায়ের মন কষ্ট পাবে না একটুও?
তাছাড়া, কুদরত তো আপন মামা। কল্পনা করলো ও, সোনাকে যদি বাঁচাতে পারে তবে আর একটু বড় হলেই নিজের কাছে নিয়ে যাবে সে। বড় করবে নিজের সন্তানের মত। হলোই না হয় কুৎসিত, দিলটাই বড় জিনিস। জ্ঞান-সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ।সোনাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে ও, কলেজ পাশ করলে বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াবে। মামাতো তো ভুলে যাবে না ছেলেটা। মনে রাখবে। বুড়ো বয়সে দেখভাল করবে।
কিন্তু মেয়ে মারা গেলে বড়ভাইও ভেঙে পড়বে। এ অবস্থায় টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু মেয়ে বেঁচে গেলে অন্য কথা। বড়ভাই-ভাবী কী খুশিটাই হবে! কুদরতকে কিছু চাইতে হবে না। বড়ভাই এমনিতেই টাকা দিয়ে দেবে। ব্যবসাতেও সাহায্য করবে। আর এই মেয়েটাও একদিন বড় হবে, বিয়ে হবে তার। তখন বিয়েতে ডাকবে না ওকে? সবাইকে বলবে না বড়ভাই কুদরতের জন্যই তার মেয়ের জীবন রক্ষা হয়েছে?
কুদরত বলবে, সবাই আল্লাহর কুদরত ভাইজান, এই কুদরত তো কেবল উছিলা।
তবু, বাচ্চাদের মাঝে পার্থক্য করা যায় না, ভাবে সে। যদি সুযোগ থাকতো তবে দু’জনকেই নিশ্চয়ই বাঁচাতাম। সব দোষ শালা ট্রাকড্রাইভারের, হাতটা নষ্ট করে দিলো। আর মমতাজের স্বামী হারামজাদা টাকাটা দিলো না, দিলে এ হাঙ্গামায় পড়তাম আমি? কিছুতেই না।
হাহাকার, আর্তনাদ বাড়ছে। এখন নামতেই হয়, নয়তো একজনের জায়গায় তিনজন মরবে। একবার মাথায় এলো ডেকে দেখবে কেউ সাহায্য করতে আসে কি না। না, আসবে না। সবার জান নিয়ে টানাটানি। সবাই নিশ্চয়ই নিচে চলে গেছে, যারা যায়নি তারা চোখ বন্ধ করে ছুটছে। কেউ সাহায্য করতে আসবে না।
মমতাজের ছেলে সোনা চোখ বন্ধ করে ঘুমায়। কিছুক্ষণ পর ঘর যখন ধোঁয়ায় ভরে গেছে তখন ঘুম ভাঙে সোনার। জানালার কার্নিশে আগুন পৌঁছে গেছে, পোড়া কাপড় ছিঁড়ে পড়ে গেছে বিছানায়। চাদরে আগুন ধরলো। নিঃশ্বাস নেয়া যায় না, কালো ধূম্র চোখ জ্বালিয়ে দেয়। কান্না শুরু হয়। এক বছরের শিশুর চলন ক্ষমতা থাকে না। আগুন যখন ওর শরীরে লাগলো তখন দুনিয়ার সমস্ত ভয়, বেদনা, বিভীষিকা এক খণ্ডে মিশে গেলো কান্নার সাথে। বেশিক্ষণ নয়। জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার আগেই নিঃশ্বাস বন্ধ হলো তার। সোনার ছোট ছোট চুলগুলো পুড়ছে তখন, বেড়ালের ছবি বসানো ছোট প্যান্ট আর নীল জামাটাও পুড়ছে। দগ্ধ মাংসের ঘ্রাণ নেয়ার কেউ অবশিষ্ট নেই আশেপাশে। সিলিং এর ফ্যানটি খুলে পড়ে যায় একসময় অঙ্গার রাঙা লাশটির ওপর। আরও অনেকক্ষণ সময় গেলে ছাই হয়ে যাবে সব।
0 comments: