পঁয়ষট্টির বইখানা


আমি বললাম, “কি বললেন?”

কোন কাহিনী হঠাৎ করে শুরু করে দেওয়ার মাঝে বড় রকমের ঝামেলা আছে। এই যে আমি বললাম কি বললেন, এই কথা শুনে আপনার ধারনা হতে পারে আমি মাছবাজারে মাছ কিনতে এসেছি। মাছওয়ালা মাছের যে দাম চেয়েছে তা দিয়ে ছোটখাটো একটা ষাঁড় কিনে ফেলা যায় আর তাই আমি পঞ্চাশ ভাগ বিস্ময় আর পঞ্চাশ ভাগ রাগ মিশিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেছি, “কি বললেন?” হতেই তো পারে, না কি?

‌ আবার এমনও হতে পারে, আমার কানে গুরুতর সমস্যা আছে। কেউ যদি বলে ‘গরু ঘাস খায়’ তবে শুনি ‘সরু বাঁশ চাই’! সুতরাং আমার সামনে দাড়িয়ে থাকা কোন ভদ্রলোকের কথা শুনে বুঝতে পারিনি বলে আবার শুনতে চাচ্ছি, তাই বললাম, “কি বললেন?”


তবে ঘটনা আসলে এমন নয়, একটু আলাদা। পরে কখন নতুন প্রশ্ন করে বসেন, তাই গোঁড়া থেকেই সব কিছু বলা শুরু করি।

গতকাল ফুটপাথের দোকানে একটা বই দেখে কিনে ফেলেছি। বইয়ের নামটা সামান্য কটমটে, The Design of the Universe। বইয়ের লেখকের নাম আরও ভয়ানক, বহুত চেষ্টা করেছি কিন্তু উচ্চারণই করতে পারিনি। কিন্তু প্রচ্ছদটা দেখে ভাল লাগল। দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম, “কত?”

দোকানীর চেহারা সুবিধের নয়, দেখলেই শেয়ালের কথা মনে পড়ে। জবাব দিল, “একশ।“

আমি আৎকে উঠার ভান করলাম, “সর্বনাশ! চল্লিশ দিবেন?”

লোকটা উদাস ভঙ্গিতে যে চটিতে বসে ছিল তা থেকে একটা কাঠি ভেঙ্গে দাঁত চুলকাতে শুরু করে হাসতে লাগল, যেন আমি খুব মজার কথা বলেছি, “আচ্ছা যান, ছাত্র মানুষ.....নব্বই।“

আমি বললাম, “পঞ্চাশ!”

দোকানী বলল, “আশি!”

আমি বললাম, “ষাট!”

দোকানী বলল, “পঁচাত্তর!”

শেষপর্যন্ত পঁয়ষট্টি টাকায় রফা করে বইটা কিনেই ফেললাম। আগেই বলেছি প্রচ্ছদ দেখে কিনেছি, কিন্তু না পড়ে পঁয়ষট্টি টাকা জলে ফেলার কোন মানে আছে? পরের দিন আমার বাড়ি যাবার কথা, বাসে উঠে বইটা শেষ করে ফেলব ঠিক করে রাখলাম।

পরের দিন, ভাল করে বইটা খুঁজে একটা বড় সাইজের সিটঅলা বাসে উঠে গেলাম। এত কঠিন একটা বই পড়ব, আরাম করে বসা দরকার। খাওয়ার জন্য দুই প্যাকেট চিপসও নিয়ে নিলাম, সাথে এক প্যাকেট বিস্কিট। কঠিন সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশুনা করতে যাচ্ছি, ঘন ঘন খিদে লাগতে পারে।

বসে বসে বাস ছাড়ার অপেক্ষা করছি, বাস ছাড়লেই বইটা পড়তে শুরু করব, তখন আমার পাশের সিটের প্যাসেঞ্জার এসে হাজির হলেন। পাশের সিটের মানুষের প্রতি আমার আগ্রহ বরাবরই কম, এবারও যে আগ্রহ সৃষ্টি হবে তেমন ভাবার কারণ নেই। তবে লোকটার সর্দি লেগেছে মারাত্মক, একটু পর পর নাক ঝাড়ছে রুমালে। কোথায় শান্তিতে বই পড়ব, এই লোকের যন্ত্রণায় তাও হবেনা আজকে।

বাস ছাড়ল, আমি মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়তে শুরু করলাম। দাড়ৃন ইন্টারেস্টিং বই! পড়তে পড়তে কখন একঘণ্টা চলে গেছে টেরই পাইনি। আমার পাশের সিটের প্যাসেঞ্জার যতটা বিরক্ত করবে ভেবেছিলাম ততটা করেনি, একটু পরেই ঘুমিয়ে গেছ। আমাদের বাস ঠিকমতই চলছিল, রাস্তায় খেল ঝাঁকি।

সে হতেই বিপত্তির শুরু।

ঝাঁকি খেয়ে আমার পাশের প্যাসেঞ্জারের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। টের পেলাম লোকটা কিছুক্ষণ নড়াচড়া করল, তারপর একটা ঢাউস সাইজ বোতল বের করে গলায় ঢকঢক করে কিছু পানি ঢালল। এরপর আর কিছু না পেয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগল আমি কি পড়ি। আমি আগেই বুঝেছিলাম এর জ্বালায় আজকে শান্তিতে পড়া যাবে না।

এই দেখুন, পাঁচটা মিনিট যায় নি, লোকটা বলে উঠল, “ভাই, কি বই পড়েন?”

আমি কি বই পড়ি তা দিয়ে ভাই তোমার কি দরকার? তবু আমি ভদ্র মানুষ বলে হাসিমুখে একবার মলাটটা উল্টে দেখালাম।

লোকটা একেবারে আমার বিপরীত, চূড়ান্ত অভদ্র, বুঝলেন? বলা নেই কওয়া নেই ফট করে বইটা টান দিয়ে নিয়ে গেল, তারপর দুই একটা পাতা উল্টে খ্যাকখ্যাক করে হাসতে শুরু করল। কত বড় বেয়াদব! আমাকে আবার প্রশ্ন করে, “বই আপনি কিনেছেন?”

একবার ভাবলাম বলে দেই আমার বই আমি কিনব না তো কি তোমার বাপ কিনে দেবে? তবু হাসি ফুটিয়ে বললাম, “হ্যা!” হাজার হোক, আমি ভদ্র মানুষ।

বেয়াদব লোকটা আবার খ্যাক খ্যাক করে হাসল, “কত দিয়ে কিনলেন?”

“পঁয়ষট্টি টাকা।“

এবার লোকটার অভদ্রতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে, হো হো করে হাসতে লাগল যেন আমি খুব হাসির একটা কৌতুক বলেছি। আবার বলে, “জলে গেছে।“

“জলে গেছে?”

“শুধু যায় নাই, ভাল মত জলে গেছে।“

“আমি আবার মুখে একটু বিরক্তি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি জলে গেছে?”

“বই কেনার টাকা।“

“বই কেনার টাকা জলে গেছে কেন?”

লোকটা আবার খ্যাক খ্যাক করে হাসল, “এটা পুরা ফালতু বই। এর চেয়ে পঁয়ষট্টি টাকা দিয়ে তোমার হাতে বেগুনি রঙের ফুল নামের একটা রোমান্টিক উপন্যাস কিনে পড়লে কাজ হবে।“

আমি এবার রেগে গেলাম। কত বড় সাহস, এত সুন্দর বইকে বলে নাকি ফালতু, “আপনি কেমন করে জানেন ফালতু? আপনি পড়েছেন?”

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে বসল, “আপনি পড়েছেন?”

“অবশ্যই পড়েছি!”

“পড়ে কি বুঝলেন? আমাকেও বুঝান একটু।”

আমি এবার একটু ভাব নিয়ে সোজা হয়ে বসলাম, এত সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে তো যেমন তেমনিভাবে কথা বলা যায় না, “আসলে আমাদের দুনিয়াটা ব্যাপক সুন্দরভাবে ডিজাইন কারা। সবকিছু হিসেবমত আছে। কিছু ধ্রুবক-ট্রুবক আছে, ওগুলো একটু উল্টা পাল্টা হয়ে গেলেই পুরা দুনিয়া ফিনিশ! এরপর ধরেন...........”

‌ আমাকে কথা বলে শেষও করতে দিল না, লোকটা দুলে দুলে হাসতে লাগল, “হো হো হো......সব ভুয়া, ফরমালিন ছাড়া ভুয়া!”

“সব ভুয়া আপনাকে কে বলল?”

“বলতে হয় নাকি? সব হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভুয়া!”

আমি এবার ভালমতন রেগে গেলাম, “আপনি লেখকের চেয়ে বেশি জানেন?”

“অফকোর্স বেশি জানি!”

“ঘোড়ার ডিম জানেন। তাহলে বলেন, সবকিছু যে এত চমৎকার করে সেট করে রাখা আছে, সব একেবারে হিসেবমত চলছে, এর ব্যাখ্যা কি?”

বেয়াদব প্যাসেঞ্জার এবার হাসি থামিয়ে একটু সিরিয়াস হল, “অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। অনেকভাবে বলা যেতে পারে।“

“যেমন?” বললাম আমি, “শুনি একটা।“

“যেমন ধরেন মাল্টিভার্স।“

মাল্টিভার্স। এ আবার কি? শব্দটা একটু কঠিনই বলতে হবে, আমি প্রথমবারের মত পাশের প্যাসেঞ্জার মানুষটিকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম। লোকটার চেহারার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বয়স পঁচিশও হতে পারে, পঞ্চাশও হতে পারে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় এলোমেলো লম্বা চুল। আমাদের চুল মাঝে মাঝে এলোমেলো হয়ে যায় ঠিক আছে, এই লোক মনে হয় ইচ্ছে করে এমন করে রেখেছে, “মাল্টিভার্স কি জিনিস?”

“একটা থিওরি আছে, স্ট্রিং থিওরি.......”

“মানে সুতা তত্ত্ব?”

লোকটা মাথা চুলকে বলল, “বলতে পারেন......স্ট্রিং থিওরি বলে সবকিছু স্ট্রিং দিয়ে তৈরি।“

“সুতা দিয়ে তৈরি সবকিছু?” আমি এবার দ্বিগুণ রেগে গেলাম, “মানুষও সুতা দিয়ে তৈরি? ফাজলামি নাকি? মানুষ কি সুতির জামাকাপড় যে সুতা দিয়ে তৈরি হবে?”

এলোমেলো চুলের মানুষটা একটু অধৈর্য হয়ে গেল, “আহা, আমি কি মানুষের কথা বলেছি নাকি? আমি মৌলিক পার্টিকলগুলার কথা বলেছি। লেপটন, কোয়ার্ক এইসব.........স্ট্রিং থিওরি থেকে আসছে সুপারস্ট্রিং থিওরি, তা থেকে মাল্টিভার্সের ধারনা। হিসেব করে দেখা গেছে এমনও হতে পারে আমাদের দুনিয়া একমাত্র দুনিয়া না, আরও দুনিয়া আছে।“

আমি মাথা চুলকালাম, “কিছুই বুঝলাম না।“

লোকটা আমার বইটার উপর একটা কিল দিল জোরেসোরে, পঁয়ষট্টি টাকার আজ সর্বনাশ হবে, “শুনেন! বিগ ব্যাঙের নাম তো শুনেছেন, নাকি? বিগ ব্যাঙের পরই তো আমাদের দুনিয়ার উদ্ভব, ঠিক আছে? দেখে মনে হয় আমাদের দুনিয়াটা আসলে ঠিক ঠিখ আমাদের জন্য ডিজাইন করা। কিন্তু এমনও হতে পারে বিগ ব্যাঙের পর অনেকগুলো দুনিয়া তৈরি হয়েছে, একেকটা একেক রকম। তার মাঝে আমাদের দুনিয়াটা এমন, সবকিছু ঠিকঠাকমত আছে, লাইফ ফর্ম করতে পেরেছে। তার মানে এই না সব ডিজাইন করা। কারণ অন্য দুনিয়া আছে যেগুলোতে হয়ত প্রাণ সৃষ্টি হতে পেরেছে, কোন কোনটাতে হয়ত পারেনি।“

এবার আমার মাথায় ঢুকল কিছুটা। ব্যাপারটা একেবারে খারাপ না, “অ.........তা ওই দুনিয়াগুলো কেমন হবে?”

লোকটা এক মুহূর্ত ভেবে বলল, “পুরাপুরি শিওর না। হতে পার আমাদেরটার মতই, হয়তো একটু পার্থক্য আছে। হতে পারে একেবারেই আলাদা।“

“কেমন পার্থক্য আছে?”

“যেমন ধরেন সায়িন্টিফিক ধ্রুবক গুলা উল্টা পাল্টা.....মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের নাম শুনেছেন?”

লোকটা বলে কি? মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের নাম আমি শুনব না? আমি সায়েন্সের ছাত্র, ক্লাস নাইনে রোল নম্বর ছিল আট! হাতে কিল দিয়ে বললাম, “অবশ্যই শুনেছি। 7.432 এর পর কিছু একটা।“

“হুম!” বলল লোকটা, “এমন হতে পারে অন্য কোন মহাবিশ্বে এই মানটা অন্যরকম, যেমন ধরেন 6.654? এরপর মনে করেন আমাদের যেমন এই যায়গায় একটা গ্রহ আছে, ওদের হয়তো নাই। আবার গ্রহ থাকলেও অন্যরকম।“

“গ্রহ আবার অন্যরকম হয় কেমন করে?”

“হতেই পারে। আমাদের গ্রহের নাম তো হল রলুন্টা, না? ধরেন ওদের গ্রহের নাম পলুন্টা!”

আমি চিৎকার করে উঠলাম, বাসের মানুষজন চট করে আমার দিকে ফিরে দেখে নিল কি হয়েছে, “পলুন্টা?”

“জি। আবার হতে পারে গ্রহের নাম.......পৃথিবী?”

আমি বললাম, “কি বললেন?”

হ্যা, এখানেই আমি বললাম কি বললেন। এবার সব পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা। আমার কাছেও পরিষ্কার, লোকটার মাথায় ছিট আছে। পৃথিবী কোন গ্রহের নাম হতে পারে? রলুন্টা, বুধ, মঙ্গল এইসব হচ্ছে গ্রহের নাম। পৃথিবী একটা ফালতু না, মানুষ শুনলে হাসবে না?

লোকটা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি থামিয়ে দিলাম, “ধুর মিয়া, চুপ যান! গ্রহের নাম নাকি পৃথিবী! যত্তোসব ফালতু প্যাঁচাল। আমার বই ফিরত দেন।“

বেয়াদব প্যাসেঞ্জার একটু বিমর্ষ হয়েই আমার পঁয়ষট্টি টাকার বইটা ফিরিয়ে দিল। আমি গ্রাহ্য করলাম না, বইটা পড়ে শেষ করতে হবে। আমাদের গ্রহের এত সুন্দর নাম রলুন্টা বদলিয়ে কিনা রেখে দিল পৃথিবী না হাতিবী!

বাসটা ঠিক মতই চলছে আবার, এমন সময় ড্রাইভার গান ছেড়ে দিল। পুরনো আমলের গান, অনেকবার শুনেছি,

“রলুন্টা আমারে চায়

রেখো না বেঁধে আমায়।“

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।