ভ্রম
রক্ত! রক্ত! রক্ত! রক্তের সমুদ্রে
উত্তাল ঢেউ। নিচ থেকে জলপরীদের মত ছিন্ন ভিন্ন মানবদেহগুলো আর্তনাদ করে ডাকছে আয়
আয় আয়........
আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল মোসাদ্দের আলীর।
বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ঘড়িটা জানান দিচ্ছে রাত সাড়ে তিনটা বাজে। মাথার উপর লাল
ডিম লাইট আর জ্বলজ্বল করতে থাকা ঘড়ির সবুজ ডিজিটগুলো মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। লাল-সবুজ,
সবুজ-লাল।
মোসাদ্দের আলী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। এক
গ্লাস পানি পাশে রাখা আছে সেটা ঢকঢক করে গিলে ফেললেন। বিয়াল্লিশ বছর আগের ঘটনাগুলো
ইদানীং প্রায়ই দুঃস্বপ্ন হিসেবে হানা দিচ্ছে। এত ভয় পাওয়া উচিৎ হয়নি।
আবার শুতে গিয়ে নিজের স্ত্রীর দিকে
তাকালেন মোসাদ্দের আলী। কি শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে! কিন্তু চেহারাটা এমন অচেনা লাগছে
কেন? চোখ পিটপিট করে তাকালেন তিনি। একি! এতো তার স্ত্রী নয়! এ কে?
চিৎকার করে উঠতে গিয়ে পারলেন না তিনি,
গলা দিয়ে একবিন্দু আওয়াজ বেরুচ্ছে না। মুখটা চিনতে পেরেছেন, কুলসুম বেগমের মুখ!
শালির ছেলেটা ছিল মুক্তিযোদ্ধা। বেশি
বাড় বেড়েছিল ওটার, ধরা খেয়েছিল মিলিটারির
হাতে। কুলসুম বেগম ছেলেকে খুঁজতে এসেছিল শান্তি কমিটির অফিসে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে গিয়েছিল মহিলা। চেয়ারম্যান সাহেব তাকে বললেন, “তোমার সাথে গোপনে সবকিছু ঠিকঠাক করি। এইসব ব্যাপার জানাজানি হইলে সমস্যা”।
হাতে। কুলসুম বেগম ছেলেকে খুঁজতে এসেছিল শান্তি কমিটির অফিসে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে গিয়েছিল মহিলা। চেয়ারম্যান সাহেব তাকে বললেন, “তোমার সাথে গোপনে সবকিছু ঠিকঠাক করি। এইসব ব্যাপার জানাজানি হইলে সমস্যা”।
আধঘণ্টা পর রাজাকার কমান্ডার
মোসাদ্দের আলীর ডাক পড়ে চেয়ারম্যান সাহেবের ঘরে। ভিতরে নিথর হয়ে পড়ে থাকা দেহটাকে
নিয়ে কি হাসাহাসিই না করেছিল তারা, ভাবলে আজও আনন্দ পায়। পরদিন কুলসুম বেগমের
লাশটা পড়ে থাকতে দেখা গেল পুকুরের ধারে, কেউ জানল না মোসাদ্দের আলী কত সুন্দর গুলি
চালাতে পারে।
প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে কম্বলের নিচ
থেকে উঠে এলেন মোসাদ্দের আলী। তিনি কি পাগল হয়ে গেছেন? এত ঠাণ্ডার মাঝেও শরীর
ঘামছে কেন? এ ঘরে আর নয়, বাইরে, বাইরে!
বাইরে বের হয়েই বড় ছেলের ঘরের দিকে
হাটা দিলেন তিনি। ছেলে অনেক বড় ডাক্তার, প্রেসারটা মাপতে হবে।
নব ঘুরিয়ে দরজা খুললেন। বিছানায় তার
ছেলে, ছেলে বৌ আর নাতনী শুয়ে আছে। প্রশান্তির ঘুম! কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “বাবা আদিল?”
কিন্তু এ তো তার ছেলের মুখ নয়! ঐ যে
মাঝখানে শুয়ে থাকা শিশুটি তো তার নাতনী নয়! শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে থাকা নারীটি তো তার
ছেলের স্ত্রী নয়! তার সামনে ঘুমিয়ে আছে ডাক্তার নরেন্দ্র রায় ও তাঁর পরিবার।
নরেন্দ্র রায় ছিলেন গ্রামের একমাত্র
শিক্ষিত ডাক্তার। ভালো ডাক্তার। আশেপাশের গ্রামেও নাম ডাক কম ছিল না। টাকা পয়সাও
ভালই। একটাই সমস্যা, শালা হিন্দু।
অতঃপর একদিন মিলিটারি নিয়ে হানা দেওয়া
হয় তার বাড়িতে। ঘরে ঢুকে দেখে ঘর খালি। মোসাদ্দের ফিরল তার সহযোগী রাজাকারদের
পানে, “এই শালা মালু, বুঝছস? এর সকল সম্পত্তি
গণিমতের মাল। যা খুশি নিয়া ল”।
ডাক্তারকে পাওয়া গেল বাড়ির পিছনে ডুবে
থাকতে, সাথে তার বউ আর বাচ্চা মেয়ে। মোসাদ্দের আলী মিলিটারিদের বললেন, “ইয়ে শালে হিন্দুস্থানি হ্যায় হুজুর”।
এরপর শুধু গুলির শব্দ, এরপর শুধু
বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকা তিনটে মৃতদেহ। গরম পানিতে ডাক্তারের স্ত্রীর মুখের একপাশ
পোড়ে গিয়েছিল তিন বছর আগে, সেই পোড়া আর ঠিক হয়নি। এই পোড়াই বাঁচিয়ে দিল তাঁকে,
নির্যাতনে জর্জরিত হয়ে মরতে হল না, গুলি খেয়ে শান্তির মৃত্যু মরেছে।
এই ঘরে আর না। নরেন্দ্র রায় এখুনি
জেগে উঠবেন। মোসাদ্দের আলীর পানি খেতে হবে, পানি।
হাঁপাতে হাঁপাতে কিচেনে গিয়ে ঢুকলেন
মোসাদ্দের আলী। পানির জগটা কোথায়? মেঝেতে কাজের ছেলেটা শুয়ে আছে। হারামজাদাটাকে
একটা ডাক দিবেন নাকি?
কাজের ছেলেটাও শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে।
ছেলেটাকে এতটা কালো লাগছে কেন? রাতারাতি গোঁফ গজাল কেমন করে? মুখটাও অন্যরকম লাগছে
যেন! এটা কামারপট্টির সেই কামারটার মুখ না?
কি সমস্যা ছিল শুয়ারের বাচ্চার?
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেব দয়ালু মানুষ, বলেছিলেন কামারগুলোকে, “তোর মুসলমান হয়ে যা”। সবাই রাজি
ছিল, ওই শুয়ার বাদে। কি সমস্যা ছিল বাবা তোর, প্রাণটা তো বাঁচত? শেষ পর্যন্ত গুলি
খেয়ে মরতে হল, নামটাও তো আজ আর মনে পড়ছে না।
পানি খাওয়া আর হল না। সারা বাড়ি শুধু
শত্রুতে ভরে গেছে। তার মেয়েটাকে মেরে ফেলবে, মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। মেয়ের ঘরের
দিকে ছুটলেন মোসাদ্দের আলী, আর দেরী করা যায় না।
মেয়েটাও ঘুমোচ্ছে, নিশ্চিন্ত ঘুম।
আবছা আলোয় মুখটা কি পবিত্রই না লাগছে। কন্যার মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন মোসাদ্দের
আলী, প্রাণ ভরা স্নেহ তার চোখে। কিন্তু মেয়েটার মুখে কষ্টের ছবি কেন?
মেয়ের মুখটা বদলে যাচ্ছে তার চোখের
সামনে। আজ হচ্ছে কি? মোসাদ্দের আলী কিছুটা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলেন, তার মেয়ের
ঘরে কে শুয়ে আছে দেখার জন্য।
মুখটা ফর্সা থেকে কাল হয়ে যাচ্ছে।
মুখটা চিনতে পারলেন মোসাদ্দের আলী। সেই কালো মুখটা আবার বদলে এক ষোড়শীর মুখ হয়ে
গেল, এই মুখটাও চেনা তার। আবার বদলে গেল, সিঁদুর কপালে একটা মুখে, অচেনা নয় এই
চেহারাটাও। প্রতিটি মুখ, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি চেহারা তার মনে দাগ কেটে আছে।
প্রতিটি মেয়েই আঁকুতি করেছিল, সম্ভ্রম ভিক্ষা চেয়েছিল, কিন্তু কাউকে ছাড় দেননি
তিনি। নিজের হাত থেকে সেই রমণীদের সম্ভ্রম রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা তার কোন কালেই ছিল
না।
তার কন্যার মুখটা বারবার বদলে যাচ্ছে।
তাকে পালাতে হবে, মেয়েগুলো জেগে উঠবে।
মোসাদ্দের আলীর ছোট ছেলেটা কুলাঙ্গার।
বলে তিনি নাকি রাজাকার, বলে তিনি নাকি দেশদ্রোহী! ঘরে রবীন্দ্র সংগীত বাজায়, বিজয়
দিবসে মিছিল করে। হ্যাহ্, বিজয় মিছিল। তলা ছাড়া দেশের আবার বিজয় মিছিল!
ছোট ছেলেটাই এখন শুধু বাকি আছে। ছেলের
ঘরে গিয়ে ঢুকলেন তিনি। আশ্চর্য, ছেলেটা জেগে উঠল তার সাড়া পেয়ে। অবাক গলায় বলল, “আব্বা, তুমি?”
মোসাদ্দের আলীর চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
এই কুলাঙ্গার তার কুলাঙ্গার নয়। এ মুখ কুলসুম বেগমের ছেলের মুখ, সেই মুক্তির মুখ।
যাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিল তারা; রাজাকার আর মিলিটারি বাহিনী
একসাথে।
মোসাদ্দের আলী শুনলেন সেই ছেলের গলা
থেকে বের হচ্ছে যেন গগনবিদারী হুংকার, “তোরা আমাদের
উপর লুকিয়ে হামলা করতে চাস? পারবি না! আমরা ঠিকই জেগে উঠি, বারবার জেগে উঠি। তোরা
বাঁচবি না, এ দেশ তোদের নয়, এ দেশ আমাদের দেশ!”
আর সহ্য করতে পারলেন না মোসাদ্দের
আলী। জান্তব চিৎকার করে চেপে ধরলেন তার ছেলের ঘরে থাকা মুক্তিযোদ্ধার গলা। কিন্তু
তিনি পারছেন না, সমস্ত শরীর কাঁপছে। মোসাদ্দের আলী হেরে যাচ্ছেন। ঘরের চেহারাও
বদলে যাচ্ছে। সব রক্তের মত লাগছে। রক্ত! রক্ত! রক্ত! রক্তের সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ।
নিচ থেকে জলপরীদের মত ছিন্ন ভিন্ন মানবদেহগুলো আর্তনাদ করে ডাকছে আয় আয় আয়........
বিঃদ্রঃ মোসাদ্দের আলী নামটি মুজাহিদ,
সাকা, দেলোয়ার, রাজাকার, আযম এবং লম্পট শব্দগুলোর প্রথম বর্ণগুলো নিয়ে বানানো
হয়েছে ভেবে ভূল করবেন না।