ম্যাগনিফাইং গ্লাস
- “আব্বা, ও আব্বা?”
আজকের খবরের কাগজে পদ্মাসেতু
প্রকল্প নিয়ে একটা জ্বালাময়ী লেখা ছাপা হয়েছে, শুরু করলে সহজে চোখ সরানো যাচ্ছে না। বাকের সাহেব তাই পত্রিকায় মুখ গুজেই জবাব দিলেন, “হু?”
- “আমাকে একটা জিনিস
কিনে দিবা?”
- “কি জিনিস?”
ছেলে ভয়ে ভয়ে বলল, “এই তো, তেমন কিছুনা। ঐদিন দোকানে দেখলাম একটা খুব পাওয়ারফুল ম্যাগনিফাইং গ্লাস
আসছে........খুব সুন্দর, মাত্র একটাই আছে। ওইটা।” এই বলে সে নিজের পিতার মুখের দিকে তাকাল। কোন অভিব্যক্তি নেই, বুঝা যাচ্ছে না ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা পাওয়া
যাবে কি না। বাকের সাহেব আবার বললেন, “দাম কত?”
- “দাম? দাম হবে পাঁচশ না
সাড়ে পাঁচশ কত যেন।” আসলে দাম ছয়শ, কিন্তু একটু কমিয়ে
বলাই ভালো। একবার রাজি হলেই হল, পরেরটা পরে দেখা
যাবে।
বাকের সাহেব লেখাটা পড়ে শেষ
করতে আরও দশটা মিনিট লাগালেন, তারপর সরাসরি ছেলের চোখের উপর চোখ রাখলেন, “বাজারে তেলের দাম
কত জান?”
- “না আব্বা, জানিনা।”
- “কম করে দেড়শ। আর তুমি চাও আমি তোমারে সাড়ে পাঁচশ টাকা খরচ করে ঘোড়ার ডিমের
ম্যাগনিফাইং গ্লাস কিনে দেই? এই জিনিস নিয়ে ঘুরে তুমি কি বিজ্ঞানী হয়ে যাইবা? যাও ঘরে যাও, বই নিয়া বস।”
ছেলে বুঝে গেছে আবদার করে কোন
লাভ হবে না, তাই এবার ঘ্যান-ঘ্যান কান্নাকাটি শুরু করল। প্রথমে দুয়েকটা হুংকার দিয়েও তেমন কোন লাভ হল না, কান্নার বেগ বাড়তেই
থাকল। শেষপর্যন্ত বাকের সাহেব রেগে মেগে বাসা
থেকে বের হয়ে আসলেন।
আজকে ভয়ানক গরম। আকাশ থেকে সূর্য যেন আগুন ঝরাচ্ছে। ছুটির দিনে বলে রাস্তায় মানুষজনও কম, কার এত শখ জেগেছে
যে এই দিনে রাস্তায় বের হবে? তবুও তিনি হেটে চলেছেন, রাগে মাথা কাজ করছে না। ছেলেটা আদর পেয়ে পেয়ে ঘাড়ে উঠেছে, হাতি ঘোড়া যা খুশি
চেয়ে বসে থাকে। এতদিন ভাল ভাল থেকেছেন, আজ থেকে দেখিয়ে
দেবেন তার রুদ্রমূর্তি কাকে বলে!
এসব চিন্তা করে করে বাকের সাহেব
শেষপর্যন্ত মনে মনে কিছুটা সান্ত্বনা পেলেন। বাসায় গিয়েই বোঝাপড়া
করা যাবে, এখন কিছুক্ষণ শান্তিতে বসা দরকার। রোদে হাটতে হাটতে
একেবারেই ঘেমে নেয়ে গেছেন।
অনেক খুঁজে একটা ভালো বসার
জায়গা বের করে বসেছেন পাঁচটা মিনিটও হয়নি, কে যেন বলে উঠল, “ভাই সাহেব, ভালো আছেন?”
রোদ বলে চোখ বন্ধ করে ছিলেন, হঠাৎ করে আগন্তুকের
মুখের দিকে তাকাতে পারলেন না। ধূসর পাঞ্জাবি, চোখে মোটা চশমা
আর একগাদা পাকা চুলের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল শুধু।
আগন্তুক আবার বললেন, “ভাই সাহেবের মনটা
ভালো নেই মনে হচ্ছে?”
বাকের সাহেব এমনিতেই যথেষ্ট
বিরক্ত হয়ে আছেন, এখন আরও বিরক্ত হলেন, “জী না, আমার মন ভালো আছে, অনেক ভালো।”
আগন্তুক হাসলেন, “আসলে আপনার মন মেজাজ
একটুও ভালো নেই। বাসায় ঝামেলা হয়েছে?”
- “হ্যাঁ হয়েছে। আমার ছেলে একহাজার টাকা দামের একটা খেলনা চাইছিল, আমি কিনে দেই নাই, ধরে বকা-ঝকা করছি। খুশি হয়েছেন?”
- “আরে আপনি এত রেগে
যাচ্ছেন কেন?”
বাকের সাহেবের চোখমুখ বিরক্তিতে
কুঁচকে গেল, “রাগব না তো আনন্দ করব? খুশিতে রাস্তায় দাঁড়াইয়া নাচব?”
- “না, না, নাচতে বলি নাই.........আমি
বলছিলাম, ছেলেমানুষ একটা জিনিস চেয়েছে, কিনে দেন না।”
- “আপনার এত শখ যখন
আপনি নিজে কিনে দেন।”
- “দিতে পারতাম। কিন্তু আপনার ছেলে আমার হাত থেকে উপহার পেলে যতটা না খুশি
হবে, আপনার হাত থেকে পেলে আরও বেশি খুশি হবে, তাই না বাকের সাহেব?”
এবার বাকের সাহেব একটু সতর্ক
হলেন, “কে বলেন তো ভাই আপনি?”
- “আমাকে মনে হয়ে চিনবেন
না। আমি আপনাদের আশে পাশেই থাকি আরকি, হে হে।”
- “আমাকে নিয়া আপনার
এত আগ্রহ কেন? মতলবটা কি ভাই?”
পাকা চুলের আগন্তুকের চোখ যেন
একেবারে কপালে উঠে গেল, “সে কি! মতলব থাকবে কেন? আমি তো ভাল করেই বলছিলাম, আপনিও তো রেগে
যাচ্ছেন। আমি তো শুধু বলতে এসেছিলাম যে বাচ্চা ছেলে
একটা কিছু চেয়েছে, দেয়ে দিলে খুব একটা ক্ষতি হবে না। একদিন ছেলে হয়তো বিজ্ঞানীও হয়ে যাবে, তাই না?”
ভদ্রলোক যেমন দমকা হাওয়ার মত
উদয় হয়েছিলেন, তেমন করেই হনহন করে পা চালিয়ে বিদায় নিলেন। পেছনে বাকের সাহেব বসে রইলেন হতভম্ব হয়ে। এই লোক কি জানে তিনি নিজের ছেলেকে বিজ্ঞানী হওয়ার কথা বলে
তিরস্কার করেছেন? নাকি কথার কথা বলল? আশ্চর্য!
আরও একটা ঘণ্টা পর যখন উঠে
দাঁড়ালেন, তখন তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। একটা ম্যাগনিফাইং
গ্লাস কিনে দিলে কি খুব খারাপ হবে? ছেলেতো আর হাতি-ঘোড়া চেয়ে বসেনি!
সেই চিন্তায় ডুবে কখন যে দোকানের
ভেতর ঢুকে গেছেন, বাকের সাহেব নিজেও বুঝলেন না। দোকানদার যখন জিজ্ঞেস করল ‘কি চাই’, তখন তার ঘোর ভাঙল, “ম্যাগনিফাইং গ্লাস
আছে, ভাল কোয়ালিটির? পাঁচ-ছয়শ টাকা দামের গুলা?”
দোকানদারের মুখ দেখে মনে হল বড়ই হতাশ হয়েছেন, “হ্যাঁ, ছিল একটা। সে তো আজকেই একজন কিনে নিয়ে গেল। আপনার লাগলে অবশ্য আমরা আনিয়ে দিতে পারি। লাগবে?..........এক কাজ করেন, সামনের সোমবার......................”
আরও কয়েকটা দোকান খুঁজেও সেই
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আর পাওয়া গেল না। বাকের সাহেব বিষণ্ণ
মনেই বাড়ি ফিরলেন। ছেলে অবশ্য ততক্ষণে
কান্নাকাটি বন্ধ করে দিয়ে একবারে শান্ত, লাফ দিয়ে তার সামনে এসে বলল, “ও আব্বা, তুম যাওয়ার একটু
পরেই তোমারে খুঁজে একজন আসছিল।”
এখন বাকের সাহেব খুব নরম গলায়
বললেন, “কে আসছিল বাবা?”
- “নাম তো বলে নাই...........পাঞ্জাবি
পরা ছিল, লম্বা, মাথায় শুধু সাদা চুল........আর চোখে বিরাট বড় একটা চশমা।”
হঠাৎ করে বাকের সাহেবের কেমন
যেন সন্দেহ হতে শুরু করল, “ছাই রঙের পাঞ্জাবি?”
- “হ্যাঁ।”
- “লোকটারে কি তুমি
কিছু বলছ?”
- “আমি কি বলব? লোকটা তো তোমার
প্যাকেটটা দিয়াই চলে গেল।”
- “আমার প্যাকেট?”
- “হ্যাঁ, তোমাকে একটা ছোট
প্যাকেট দিয়া গেছে। নিয়া আসি?”
- “আস।”
চ্যাপ্টা প্যাকেটটা হাত পেয়েই
বাইরের গিফট প্যাপারটা ছিঁড়ে ফেললেন তিনি। একটা বাক্স বের
হয়ে এলো। কাঁপা হাতে বাক্সটা খুললেন বাকের সাহেব।
ভেতরে সযত্নে রাখা একটা ম্যাগনিফাইং
গ্লাস!