তিন আসামীর গল্প (The Three Prisoners' Paradox)
১. গল্প
অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক জেলখানায় ছিল তিন ফাঁসির আসামী – পিচ্চি, হ্যাংলা আর ঢ্যাংগা।
দেশের প্রেসিডেন্ট একদিন ঠিক করলেন তিনজনের মাঝে একজনকে বিশেষ ক্ষমায় মুক্তি দেওয়া হবে। লটারি করে একজনকে বাছাইও করা হল। কাকে বাছাই করা হল তা জানল শুধু জেলখানার জেলার।
কিন্তু ঢ্যাংগা গোপন কোন সূত্র থেকে খবরটা পেয়ে গেল, যে তিনজনের মাঝ হতে একজনকে মুক্তি দেওয়া হবে। সে তখন গিয়েই জেলারকে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার, কে মুক্তি পাবে বলেন”।
জেলার বলল, “দেখ ঢ্যাংগা, এটা গোপন তথ্য। তোকে আমি জানাতে পারব না কে মুক্তি পাবে”।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে ঢ্যাংগা বলল, “তাহলে স্যার আমাকে বলেন যে দুইজন মুক্তি পাবে না তাদের একজনের নাম। যদি পিচ্চি মুক্তি পায় তাহলে বলেন হ্যাংলার নাম, হ্যাংলা মুক্তি পেলে বলেন পিচ্চির নাম। আর যদি আমি মুক্তি পাই তাহলে একটা কয়েন টস করেন, যদি হেড পরে তাহলে বলেন পিচ্চির নাম, আর টেল পরলে বলেন হ্যাংলার নাম”।
জেলার সাহেব এবার বেজায় বিরক্ত হলেন, “তুই অনেক ঝামেলা করিস রে ঢ্যাংগা। আমি যদি এখন টস করে তাহলেই তুই বুঝে যাবি তুই বাঁচবি। আর যদি টস না করেই একজনের নাম বলি তাহলে বুঝে যাবি অন্যজন বাঁচবে”।
ঢ্যাংগা কিন্তু সহজে ছাড়ার লোক নয়। সে বলল, “আচ্ছা, আমাকে কাল বলেন, আজকে চিন্তা ভাবনা করেন”।
রাতে শুয়ে জেলার চিন্তা করে দেখল, সে যদি ঢ্যাংগাকে কারও নাম বলে দেয়, তাহলে কিছুতেই সে বের করতে পারবে না কে মুক্তি পাচ্ছে। তাই পরের দিন জেলার সাহেব ঢ্যাংগাকে বলল, “পিচ্চির ফাঁসি হবে”।
যাইহোক, জেলার জানতো না যে ঢ্যাংগা জেলখানায় বিশেষ পদ্ধতিতে হ্যাংলার সাথে যোগাযোগ করতে পারত। ঢ্যাংগা তখনই গিয়ে বলল, “ওই হ্যাংলা, শুন। আমাদের মাঝে পিচ্চি মারা যাবে। তারমানে পিচ্চি মারা যাবে এই তথ্যটা জানার আগে আমাদের একেকজনের বাঁচার প্রোবাবিলিটি ছিল 1/3, এখন আমার বাচার প্রোবাবিলিটি হল 1/2 ”।
কথাটা শুনে হ্যাংলা একটু চিন্তা করে দেখল, ব্যাপারটা ভালই হল । তার নিজেরও বাঁচার সম্ভাবনা 1/3 থেকে বেড়ে গিয়ে 1/2 হয়ে গেছে!
কিন্তু সত্যিই কি তাই?
২.গাণিতিক-অগাণিতিক
সমস্যাটার একটা নাম আছে, The Three Prisoners Paradox। সমস্যাটা প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ১৯৫৯ সালের সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের একটা সংখ্যায়, মার্টিন গার্ডেনারের Mathematical Games কলামে। আমরা এখন একটু ভাল করে চিন্তা করে দেখি সমস্যাটার সমাধানটা, মানে ঢ্যাংগার সমাধানটা ঠিক আছে কিনা।
সহজ ভাবে চিন্তা করে দেখলে, যখন পিচ্চি, ঢ্যাংগা আর হ্যাংলা তিনজনের মুক্তি আর ফাঁসির ব্যাপারে আমরা কিছু জানতাম না, তখন আমরা জানি যে তিনজনের প্রত্যেকের বেঁচে যাওয়ার প্রোবাবিলিটি ছিল 1/3। কিন্তু যেই জানা গেল পিচ্চি মারা যাবে, তখনই বেঁচে যাওয়ার মত রইল ঢ্যাংগা আর হ্যাংলা, সহজ হিসেবে তাদের প্রত্যেকের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা এসে দাঁড়ালো 1/2 এ।
কিন্তু আসলেই কি তাই? এখানে যে সমস্যাটা আছে তা হল, এই হিসেবে ঢ্যাংগা যখন জেলার সাহেবকে প্রশ্ন করল এবং উত্তর দেওয়ার শর্তটা জানাল, তখনই ঢ্যাংগার বেঁচে যাওয়ার প্রোবাবিলিটি বেড়ে গেল, 1/3 থেকে 1/2। কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব? প্রশ্নটা আবার দেখা যাক। এই শর্তে পিচ্চি বাঁচুক, হ্যাংলা বাঁচুক বা ঢ্যাংগাই বাঁচুক, জেলার কিন্তু কখনও ঢ্যাংগা মারা যাবে এই কথাটা বলবে না। তারমানে ঢ্যাংগা বাঁচুক বা মরুক, নাম বলা হবে পিচ্চি বা হ্যাংলার, প্রশ্নটা করার সময়ই ঢ্যাংগা এটা জানতো। তারমানে জেলারকে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই আসলে ঢ্যাংগার বাঁচার প্রোবাবিলিটি দুম করে বেড়ে গেছে!
এখন একটু বড় পরিসরে চিন্তা করে দেখা যাক। ধরা যাক, আসামী আছে ১০০০ জন, তারমানে এখন ঢ্যাংগার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা হল 1/1000=0.001। এবার ঢ্যাংগা যে কাজটা করবে তা হল প্রায় এরকমই একটা শর্ত দিয়ে জেলারকে বারবার প্রশ্ন করে তার বাঁচার প্রোবাবিলিটি বাড়াবে (জেলারও উত্তর দিবে বটে)। তারমানে একসময় দেখা যাবে আমাদের ঢ্যাংগার বাঁচার প্রোবাবিলিটি বেড়ে গিয়ে 0.5 এ দাঁড়াবে!
কিন্তু সমস্যা হল, সাধারণ ভাবে চিন্তা করে দেখলে সমাধানটা করা যাবে না। ঢ্যাংগা যখন প্রশ্ন করলো তখনই তার বাঁচার প্রোবাবিলিটি হল 1/3, এবং তখনই সে জানতো যে বলা হবে পিচ্চি বা হ্যাংলার নাম। তারমানে জেলার কেবল একটা আনুষ্ঠানিক উত্তর দেওয়ার কারণেই কি ঢ্যাংগার বাঁচার প্রোবাবিলিটি বেড়ে যাবে? এ যেন এরকম, জেলার বলল সূর্য পূর্ব দিকে উঠে, আর তাতেই ঢ্যাংগার বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে গেল!
হ্যাঁ, ঘটনাটা এখন যতটা বিদঘুটে ঠেকছে, আসলে তেমনই বিদঘুটে। ঢ্যাংগার হিসাবে ভুল আছে, তার বাঁচার প্রোবাবিলিটি আসলে বদলাবে না, 1/3 ই থাকবে। পিচ্চির বাঁচার প্রোবাবিলিটি আমরা জানি এখন 0, তারমানে হ্যাংলার বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে হবে 2/3।
কিন্তু এটা কেমন হল? বাঁচার সম্ভাবনা তো বেড়ে গেল হ্যাংলার। এখন আমাদের বুঝতে হবে তথ্যের সাথে প্রোবাবিলিটি গণনার সম্পর্ক। যেমন, আমাদের জেলার সাহেব জানেন কে মুক্তি পাবে। তারমানে তার কাছে একজনের বাঁচার সম্ভাবনা 1, অন্যদের 0। প্রথমে আমাদের কাছে তিনজনের প্রত্যেকের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল 1/3, পিচ্চি মারা যাবে এ তথ্যটা জানার পর ঢ্যাংগার রইল 1/3, হ্যাংলার হল 2/3। তারমানে হিসেবের সময় তথ্যের প্রয়োজন আছে। আমাদের কাছে যে ধরনের তথ্য আছে, তা দিয়ে হিসেব করা হয়েছে বলেই হ্যাংলার বাঁচার প্রোবাবিলিটি বেড়ে গেছে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যদি ঢ্যাংগা বেঁচে যায় তাহলে জেলার পিচ্চির নাম বলবে এই সম্ভাবনা 1/2(টসের উপর নির্ভর করে), কিন্তু হ্যাংলা বেঁচে গেলে পিচ্চির নাম বলার সম্ভাবনা 1। তারমানে আমরা যখন জানতে পারলাম পিচ্চি মারা যাবে, তখন আমাদের কাছে ঢ্যাংগার চেয়ে হ্যাংলার বাঁচার সম্ভাবনা একটু বেশিই হবে।
এখনও সবটা সমাধান ঘোলাটে হয়ে আছে আমি জানি। এতক্ষণ আমরা অগাণিতিক হিসেব করে সমাধান করতে চেয়েছি, এবার একেবারে নিখুঁত গাণিতিক হিসেব করে দেখা যাক। শর্তযুক্ত প্রোবাবিলিটি নিয়ে কাজ করার জন্য খুব চমৎকার একটা অস্ত্র হলো বায়েস ল (Bayes Law)। দুঃখজনক ভাবে এখানে আমরা সূত্রটা ব্যাখ্যা করতে পারছি না, যথেষ্ট বড়। কারও জানা না থাকলে উচ্চ মাধ্যমিক বিচ্ছিন্ন গণিত বই দেখে নিতে পারে (এমনিতে বায়েস ল খুব চমৎকার জিনিস, কিন্তু আমাদের দেশের পাঠ্যবই লেখার পদ্ধতির জন্য সেই চমৎকারটাই বিদঘুটে হয়ে দাঁড়িয়েছে)।
মনে করি, পিচ্চির বেঁচে যাওয়ার ঘটনাটা হল A, হ্যাংলার B, ঢ্যাংগার C। পিচ্চির নাম বলার ঘটনাটা হল N। হিসাবটা শুরু করতে হবে প্রথম থেকে। আমরা জানি ঢ্যাংগার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা P(C)=1/3, ঢ্যাংগা বেঁচে গেলে পিচ্চির নাম বলার সম্ভাবনা P(N|C)=1/2, যেহেতু কয়েন টস করা হবে। একইভাবে হ্যাংলার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা P(B)=1/3, হ্যাংলা বেঁচে গেলে পিচ্চির নাম বলার সম্ভাবনা P(N|B)=1। পিচ্চির বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা P(A)=1/3, পিচ্চি বেঁচে গেলে পিচ্চির নাম বলার সম্ভাবনা P(N|A)=0।
সুতরাং, পিচ্চির নাম বললে হ্যাংলার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা,
যেহেতু পিচ্চির নাম বললে পিচ্চির বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা 0, তাহলে পিচ্চির নাম বললে ঢ্যাংগার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা P(C|N) = 1 – 2/3 = 1/3।
এত হিসেব করার পর আমাদের একটা কথাই বলার থাকতে পারে, “বেচারা ঢ্যাংগা”।