একটি ভুয়া রবীন্দ্রনাথ ক্লোনের গল্প


"আসুন আসুন, এবার বিশেষ একজন ব্যক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।"
যার উদ্দেশ্যে বলা তার চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। এত বড় প্রজেক্ট কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্যে পরিদর্শনে এসেছিলেন তা কি সফল হয়েছে বিন্দুমাত্র? মোটেও না।
প্রজেক্টের হর্তাকর্তারা তাকে খুশি করার চেষ্টা কম করেছে সেটা বলা যাবে না। এত ঝামেলার মাঝে প্রাইভেট হেলিকপ্টার পাঠানো, তার উপর এই নির্জন দ্বীপে এই পরিমাণ ভুরিভোজ, একেবারে ফেলে দেওয়ার মত নয়। তবে খুশি তো করতেই হবে, নাহলে তিনি আর ফান্ড পাঠাবেন কেন? হাজার হোক, সরকারের এতবড় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি। বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়, কলেজ পর্যন্ত তো সায়েন্সেরই ছাত্র ছিলেন। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় প্রজেক্টও দিয়েছিলেন একবার, লেবুর রস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন।
গত সপ্তাহে কালোমতন লোকটা এসে যখন তাকে প্রজেক্টের কথা বললো তখন কিছুটা বিরক্তই হয়েছিলেন, "কী করছেন আপনারা?"
লোকটা হাত কচলাতে কচলাতে বলেছিলো, "জী স্যার, মানব ক্লোনিং। সহজ ভাষায় বলতে গেলে নতুন মানুষ তৈরী?"
তিনি আরও বিরক্ত হয়ে বললেন, "মানুষ তৈরী তার জন্য এত টাকা করে এত বড় প্রজেক্ট বানানোর দরকারটা কোথায় ছিলো? দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জানেন। আমার শালার বৌয়ের বাচ্চা হলো তিনমাস আগে। বেশ বড় ক্লিনিকে ভর্তি করাতে গেলাম, জায়গাই পাওয়া যাচ্ছে না। লাখ লাখ মানুষ তৈরী হচ্ছে প্রতিদিন খবর রাখেন?"
হাত কচলানো বন্ধ করে লোকটা একটু অস্থির হয়ে গেলো, "না না স্যার, এটা ঠিক এমন বিষয় না। আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। আমরা কারও ডি.এন.এ. থেকে তার হুবহু একটা কপি রেপ্লিকেট করার চেষ্টা করছি। ধরেন আপনি, আমরা চেষ্টা করলে ঠিক আপনার মত দেখতে-শুনতে আরেকজন মানুষ তৈরী করতে পারবো।"
"তো সেটা নতুন কী আবার? গতবছরই না শুনলাম ভার্সিটির একদল ছাত্র কোন রকস্টার না কার যেন কপি বানিয়ে ফেলেছে।"
"হ্যা স্যার, হিউম্যান ক্লোনিং এর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর এটা এখন নতুন কিছু না। কিন্তু আমাদের প্রজেক্টটা আলাদা। আমরা বিখ্যাত মানুষদের ক্লোন করার চেষ্টা করছি। আর একটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে তাদের সত্যিকারের জীবনের কাছাকাছি এক জগতে বাস করার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছি। বিশেষ ধরনের গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করেছি কয়েকবছরের মধ্যে তাদের পূর্ণবয়স্ক করে তুলার জন্য। আপনি বলতে পারেন আমরা যার ক্লোন করছি সে অরিজিনাল কপির শতকরা পঞ্চাশ থেকে ষাট ভাগ অভিজ্ঞতা অর্জন করছে।"
এই কথা শুনে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, "হ্যা এটা একেবারে খারাপ না। তো আমাকে কী দরকার?"
লোকটার হাত কচলানো শুরু হলো, "বুঝতেই পারছেন স্যার, এত বড় প্রজেক্ট। আপনি একবার পরিদর্শন করে কেবল যদি সার্টিফাই করে দিতেন.............."
তিনি সার্টিফাই করতে এসেছিলেন এই ভেবে বিখ্যাত কোন মানুষের সাথে আলাপ করে নিজের দাম বাড়ানো যাবে। তার বৌ হাতে একটা খাতাও ধরিয়ে দিয়েছিলো অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কীসের কী? প্রথমে যার সাথে দেখা হলো তার নাম অয়লার, সে নাকি আবার অংক করে বসে বসে। এই লোকের ক্লোন করে লাভটা হচ্ছে কোথায়?
পরেরজন একজন ফুটবলার, তার নাম পেপে। ওই টেকো তাকে দেখেই যেভাবে তেড়ে এলো তিনি কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালালেন।
এরপর বহু ঘুরাঘুরি করে কালোমতন লোকটা তাকে নিয়ে এলো এই দরজার সামনে, "স্যার, ইনি বেশ স্পেশাল। অনেক অনেক আগের মানুষ, কিন্তু এখনও তার গল্প-কবিতা পড়ানো হয়। আপনিও নিশ্চয়ই পড়েছেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"
রবীন্দ্রনাথ! হ্যা, তার কবিতা-গল্প কে না পড়েছে? ছোটবেলায় তিনি নিজেও রবীন্দ্রনাথের মত কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন,
"আমি গিয়েছিলেম এক বনে
সেখান হতে প্রাণপনে
ফিরিয়া আসিয়াছি ব্যাঘ্রের তাড়া খেয়ে
আসিয়া দেখি বন কাকে গেছে ছেয়ে।"
শিশুকালের আইডলের সাথে দেখা করতে কে না চায়, "আরে রবীন্দ্রনাথ? আগে বলবেন না? তাড়াতাড়ি চলেন। কত বড় লোক।"
দরজা খুলে দেখা গেলো রবীন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। কালোমতন লোকটা এগিয়ে গিয়ে একটা নমস্কার জানালো, "ঠাকুরবাবু, এই যে আমাদের স্যার। আপনার সাথে দেখা করতে করতে এসেছেন।"
তিনি ভাবলেন এই ফাঁকে রবিঠাকুরকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ তিনিও একজন কবি। দূরত্বটা যত কমবে তত তাড়াতাড়ি আলাপ জমবে। তিনি বলে উঠলেন, "হে কবিগুরু, রজনীর শশী, সাক্ষাৎ করিয়া আমি হইলেম খুশি?"
কী অসাধারন দুটো লাইন ভেবেছেন তিনি! রবিঠাকুর কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ কালোমতন লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ইনি কে হে? ইনি এভাবেই কথা বলেন নাকি?"
তার কিছুটা সন্দেহ হলো হঠাৎ। সবকিছু ঠিকঠাক ঠেকছে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "জানিয়া নিক স্বর্গ জানিয়া নিক মর্ত্য, আপনি যে রবিঠাকুর এ বাণী কি সত্য?"
রবিঠাকুর হতভম্ব হয়ে বললেন, "সত্য হবে না কেন? তো ইনারা ক্লোনিং এর কথা বলছিলেন কী যেন, আমি মাথা ঘামাইনি তেমন।"
এবার তিনি রেগে গেলেন। সব কিছু তার কাছে পরিষ্কার। সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেছে। রেগেমেগে আঙ্গুল তূলে তিনি বললেন, "এই লোক ভুয়া রবীন্দ্রনাথ!"
কালোমতন লোকটা চমকে গিয়ে বললেন, "স্যার, ভুয়া মানে মানে আমি বুঝতে পারছি না...."
ভুয়া রবীন্দ্রনাথও হা করে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, "ফাজলেমি করেন আমার সাথে, অ্যা? অয়লার না ব্রয়লার, লাউ না পেপে ওদের তো চিনি না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে চিনবো না আমি? এত বড় ফাজলেমি?"
ভুয়া রবীন্দ্রনাথ বললেন, "আপনার কোন সংশয় হচ্ছে মনে হচ্ছে?"
"কীসের সংশয়। রবীন্দ্রনাথ এভাবে কথা বলেন না! তিনি সাধুভাষায় কথা বলেন। তিনি বলবেন না সত্য হবে না কেন, তিনি বলবেন সত্য হইবে না কেন। তিনি বলবেন আপনার কোন সংশয় হইতেছে বলিয়া বোধ হইতেছে। আমাকে ফাঁকি দেওয়া এতই সোজা? দেখে নিবো সবাইকে।"
গটগট করে হেটে বের হয়ে এলেন তিনি। পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পেতেন কী সেটা বলা যাচ্ছে না কারন তিনি পিছনে তাকাননি আর।
*****
দুইদিন পরই খবর এলো 'উচ্চপদস্থ অফিসারের চতুরতায় মানব ক্লোনিং প্রজেক্টের প্রতারণা ফাঁস: পেপে নামক ব্যক্তির আঘাতে দুইজন পুলিশ গুরুতর আহত'
[হঠাৎ করে এই অপঠ্য কাহিনী বলার ইচ্ছা কেন হলো সেটা আমি নিশ্চিত না। কেউ পড়ে হজম করতে পারলে তাকে অভিনন্দন, লেখা শেষ করার পর আমি নিজেই দ্বিতীয়বার পড়ার সাহস করিনি।]

মৃন্ময়

নিজের বিষয়ে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। তাই আমি নিজের বিষয়ে কিছু বলব না।